ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পর্দার অন্তরালে থেকে কোন রাজনৈতিক মহল কলকাঠি নাড়ছে কি-না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে ;###;আতঙ্ক ছড়াতে বেছে বেছে খুন করা হচ্ছে বিদেশী নাগরিক, শিক্ষক, ব্লগার, পুরোহিত ও পুলিশ ;###;দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

ছক কষে কিলিং ॥ তিন বছরে শিকার ৩০ জন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

ছক কষে কিলিং ॥ তিন বছরে শিকার ৩০ জন

শংকর কুমার দে ॥ দেশে রীতিমতো ছক কষে পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে একের পর এক ঘটানো হচ্ছে টার্গেট কিলিং। গত ৩ বছরে দেশে বিদেশী নাগরিক, শিক্ষক, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, পুরোহিত, ধর্মযাজক ও পুলিশসহ শ্রেণী-পেশার টার্গেট কিলিংয়ে শিকার হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। তবে গত কয়েক দিনে টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় আতঙ্ক-উদ্বেগ ছড়ানো হয়েছে এমনভাবে যেন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এটা এক গভীর ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা। সরকারকে বেকাদায় ফেলার উদ্দেশে পর্দার অন্তরাল থেকে কোন রাজনৈতিক মহল থেকে কলকাঠি নাড়নো হচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশে গত ৩ বছরে টার্গেট কিলিং হয়েছে অন্তত ৩০ জন। এ সকল ঘটনার শিকার হয়েছেন বিদেশী নাগরিক, শিক্ষক, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, পুরোহিত, ধর্মযাজক ও পুলিশ। প্রতিটি হত্যাকা- ছিল টার্গেট কিলিং। কিন্তু গত কয়েক দিনে এমন কয়েকটি টার্গেট কিলিং ঘটেছে যা হঠাৎ করেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা। এসব ঘটনা একেবারেই অস্বাভাবিক। এর মধ্যে গত ২৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সেনা সদস্যকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আগের দিন ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় দুজনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। একই দিনে গাজীপুরের কাশিমপুরের সাবেক কারা সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর রুস্তম আলী হাওলাদারকে কারাগারের অদূরেই গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এর দুদিন আগে ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার আগের দিন গোপালগঞ্জে ২২ এপ্রিল দুর্বৃৃত্তরা ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে সাধু পরমানন্দ রায়কে। কুমিল্লা সেনানিবাসে কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকা-ের ঘটনাও ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। এর মধ্যে কলাবাগানের জোড়া খুন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুনে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলে বিদেশী প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, যার জোড়ালো প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী বিদেশী রাষ্ট্রসমূহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে ‘টার্গেট কিলিং’ হচ্ছে। অর্থাৎ এসব হত্যাকা-ের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে বলেই ইঙ্গিত করেছেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র সব সময় ছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে টার্গেট কিলিং করা হচ্ছে। হত্যাকা-ের দায়িত্ব স্বীকার করে আলকায়দার নামে বার্তা আসার দাবিকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসব হত্যাকা- ‘২০ দলীয় জোটসহ সুবিধাভোগীরা’ করাচ্ছে। শিবির ও জঙ্গী সন্ত্রাসীরা কখনও জেএমবি, কখনও আনসারুল্লাহ বাংলাটিম বলে খুন করছে। আসলে জামায়াত-বিএনপি যাই হোক, শেকড় এক বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগের দিন বলেছেন, যে সকল হত্যাকা- ঘটেছে তার সবই তদন্ত করে খুনীদের আইডেন্টিফাই করে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সন্দেহভাজন জঙ্গীদের হামলায় গত বছর বেশ কয়েক লেখক, প্রকাশক, অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট হত্যাকা-ের পর এ বছর এই মাসে প্রথমে খুন হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হওয়ার দুদিনের মধ্যে একই কায়দায় চাপাতির আঘাতে হত্যা করা হয় জুলহাস ও তনয়। জুলহাস ও তনয় হত্যাকা-ের দায়িত্ব স্বীকার করে আলকায়দার নামে বার্তা এসেছে। রাবি শিক্ষক হত্যাকা-ের দায় স্বীকারের বার্তা এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গীগোষ্ঠী আইএসের নামে। গত তিন বছরে দেশে টার্গেট কিলিংয়ের শিকারে পরিণত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতজন। এ ছাড়াও ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ, ২৪ ডিসেম্বর রাবির অধ্যাপক ড. ইউনুস। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীতে ব্লগার রাজিব হায়দার, ৯ এপ্রিুল বুয়েট শিক্ষার্থী আরিফ রহমান দ্বীপ, ২১ ডিসেম্বর পীর লুৎফর রহমানসহ ৬ সহযোগী, ২০১৪ সালের ১ আগস্ট সাভারে ব্লগার আশরাফুল আলম, ২৭ আগস্ট ঢাকার রাজাবাজারে টিভি উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, ১৫ নবেম্বর রাবির অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাবিতে মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়, ৩০ এপ্রিল তেজগাঁওয়ে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস, ৭ আগস্ট পূর্ব গোরানে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নীলাদ্রি চটোপাধ্যায় ওরফে নিলয়, ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে ফকিরসহ ২ জন, ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার, ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ায় জাপানী নাগরিক কোনিও হোশি, ৫ অক্টোবর বাড্ডায় বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খিজির খান, ২২ অক্টোবর মিরপুর শাহ আলীতে পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম, ২৪ অক্টোবর হোসনি দালানে ২ জন, ৩১ অক্টোবর শাহবাগে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ৪ নবেম্বর আশুলিয়ায় পুলিশের এক কনস্টেবল, ১০ নবেম্বর রংপুরে এক মাজার খাদেম, ২৬ নবেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে মসজিদের এক মুয়াজ্জিন, ১০ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গায় এক বাউল আয়োজক, ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারা আহমেদিয়া মসজিদে একজন এবং ২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল সূত্রাপুরে গণজাগরণ মঞ্চকর্মী নাজিমউদ্দিন সামাদ জিহাদী গোষ্ঠীর টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন। গোয়েন্দা সূত্র জানান, প্রতিটি হত্যাকা- ও হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের’ ওয়েবসাইটে দায় স্বীকার করে বিবৃতিও দেয়া হয়েছে ইসলামী স্টেটস’র (আইএস) ব্যানারে। সরকারের তরফে এ সকল বিবৃতি কখনই আমলে নেয়া হয়নি। বলা হয়েছে দেশে আইএস’র কোন অস্তিত্বই নেই। দেশীয় জঙ্গীগোষ্ঠী এ সকল টার্গেট কিলিংয়ের জন্য দায়ী। সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটই পরিকল্পিতভাবে হত্যাকা-গুলো ঘটাচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এ সকল টার্গেট কিলিংয়ের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই ধরনের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুনীরা বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছে। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ধারালো চাপাতি নয় তো ছুরি। প্রতিটি হত্যাকা-ে ‘কতল’ করার প্রবণতা স্পষ্ট যা কেবল জিহাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দেখা যায়। পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, কিলিং মিশনগুলো মূলত পরিচালনা করছে দেশী জিহাদী গোষ্ঠীগুলো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়েই এই জিহাদী জঙ্গী গোষ্ঠীর দেশব্যাপী বিস্তার ঘটে প্রকাশ্যে। দেখা যাচ্ছে, অতীতের মতোই দেশের বিভিন্ন স্থানে এ যাবত যত হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে তার সবই মূলত একই কায়দা ও কৌশলের। যারা এই কিলিং মিশন পরিচালনা করছে তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এরা ইসলামী লেবাসে অপারেশনে অংশ নিচ্ছে না। বেশিরভাগ কিলিং মিশনেই এরা জিন্স প্যান্ট ও টি শার্ট পরে অংশ নিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, টার্গেট কিলিংয়ের আগে এ ধরনের কিলাররা মিশন পরিচালনার আগে প্রথমে টার্গেটগুলো ‘ ‘রেকি’ করছে। ‘রেকির’ পরই তারা হামলার সময় বা ক্ষণ নির্ধারণ করছে। দেশের ভেতরে এ পর্যন্ত যে কয়টি টার্গেট কিলিং হয়েছে তার প্রতিটিতে দক্ষভাবে মিশন পরিচালনা করেছে জিহাদী গোষ্ঠীগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কিলিং মিশন সফল হয়েছে। তবে দু’একটি ক্ষেত্রে তারা টার্গেট মিসও করেছে তার নজিরও আছে। তবে এ সকল টার্গেট কিলিংয়ের বাইরে তারা বিস্ফোরক হামলায় পারদর্শীতাও দেখিয়েছে। রাজধানীর পুরনো ঢাকার হোসনি দালানে আশুরা মিছিল, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির, চট্টগ্রামের ঈসা খাঁ ঘাঁটি মসজিদে, রাজশাহীর বাগমারায় আহমেদিয়া মসজিদ ও বগুড়ার কাহারোলে ইসকল মন্দিরে বোমা হামলা জিহাদী গোষ্ঠীর সফল অভিযান অন্যতম। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করে যে, মুক্তচিন্তার নামে মূলত ইসলাম ধর্ম, নবী-রাসুলদের নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখি, মাজার পূজা, পীর পূজা, সমকামিতায় সমর্থন ও নাস্তিকতার মতো ঘটনাগুলো উস্কে দিচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতিকে। এসব লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই প্রধানত টার্গেট হচ্ছে গোষ্ঠীটির। এসব লেখালেখি বন্ধ করার ব্যাপারে খোদ সরকারপ্রধান ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। পুলিশের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ পর্যন্ত জিহাদী গোষ্ঠীগুলো যে সকল হত্যাকা- সংঘটিত করেছে তার অধিকাংশই এখনও তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুনীদের শনাক্ত করা যায়নি। কোন কোন হত্যাকা-ে বিরোধী শিবিরের নেতাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত কিলাররা আড়ালে থেকে গেছে। তবে কোন কোন টার্গেট কিলিংয়ের খুনীরা শনাক্ত ও গ্রেফতার হয়েছে। তবে টার্গেট কিলিংয়ের যারা হোতা তাদের শিকর এতই গভীরে যে তদন্ত সেখান পর্যন্ত পৌঁছায়ই না, যার ফলে পুনরাবৃত্তি ঘটছেই। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সরকারকে উৎখাতের জন্য ইতোমধ্যেই বিরাট অংকের টাকায় বিদেশে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় বানচাল, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল, সরকার উৎখাতের জন্য নানা ধরনের অপপ্রচার করা হচ্ছে বিদেশে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অপহরণ ও হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ঢাকায় ও লন্ডনে বিএনপির হাইকমান্ডের কয়েক দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত, সাংবাদিক শফিক রেহমান গ্রেফতার ও গোপন বৈঠকের কথা স্বীকারোক্তি, অপর কারাবন্দী সাংবাদি মাহমুদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরসহ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের জন্য আগে থেকে পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য টার্গেট কিলিংয়ের মতো ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে গোয়েন্দারা।
×