ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুতুল নাচ

আপন বলয়ে ফিরে আসা, কার্টুনের চেয়ে মজার

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

আপন বলয়ে ফিরে আসা, কার্টুনের চেয়ে মজার

সমুদ্র হক ॥ পুতুল নাচ দেখে মনে হবে সত্যিই পুতুলগুলো কথা বলছে। লোকজন পরিবার নিয়ে এ নাচ দেখে আনন্দ পায়। ছোটদের কাছে কার্টুনের চেয়ে পুতুল নাচ বেশ মজার। এবারের বর্ষবরণে বাঙালীর সংস্কৃতির ঐতিহ্য পুতুল নাচ ফিরে এসেছে নিজের আপন বলয়ে। এবার বগুড়ার বৈশাখী মেলায় পুতুল নাচ ছিল পরিচ্ছন্ন। সকল বয়সী দর্শক এ পুতুল নাচ দেখে প্রশংসা করে। দেশের অন্যতম পুতুল নাচিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রয়েল বীণা পুতুল নাচের আধিকারিক হাবিব জানালেন, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভালে তারা পুরস্কৃত হয়েছেন। বিশেষ ধরনের এ পুতুল বানানো হয় শোলা ও হালকা কাঠি দিয়ে। শোলা দিয়ে নানা কিছু বানানোর কারিগর আছে। এই কারিগররাই বানায় বড়-ছোট-মাঝারি নানান আকৃতির পুতুল। এ পুতুল সাধারণত চার ধরনের। তারের পুতুল, লাঠি পুতুল, ছায়া পুতুল ও বেণি পুতুল। এসব পুতুলকে গল্পের বর্ণনা অনুযায়ী পোশাক অলঙ্কার টোপর পাগড়ি পরিয়ে সূক্ষ্ম তার, সুতা ও চিকন কাঠির শৈলীতে নাচানো হয় মঞ্চে। পুতুলের সঙ্গে নানান জিনিসপত্র প্রাণীও আসে মঞ্চে। গল্পের প্রয়োজনে এগুলো মঞ্চে আসে। যেমন নৌকায় করে এসেছিল রাজকুমার। পুতুল নাচের মঞ্চে প্রথমে আসে নৌকা তারপর রাজকুমার। এভাবে গল্প এগিয়ে যায়। মঞ্চের একধারে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসেন বাদকরা। আরেকধারে সংলাপ ও গান পরিবেশনের জন্য বসেন কণ্ঠশিল্পীরা। মধ্যের মূল মঞ্চে কালো কাপড়ে ঘেরা বিশেষ ধরনের মঞ্চ। এখানেই নাচানো হয় পুতুল। ওপর থেকে সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে পুতুল নাচানোর টেকনিক সম্পূর্ণ আলাদা। এজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। গল্পের সংলাপ ও গানের সঙ্গে পুতুলের নাচানাচির মিল না থাকলে তা পুতুল নাচ হয় না। পুতুল নাচের নেপথ্যের শৈলীরা গল্পের বর্ণনার সঙ্গে এমনভাবে পুতুলদের নাচায়- মনে হবে পুতুল অভিনয় করছে। পুতুল নাচ প্রদর্শনের এ মোহজাল সৃষ্টি সম্পূর্ণ টিমওয়ার্ক। টিমের কোন এক অংশ ভুল করলে বা খসে পড়লে পুরো দায় গিয়ে বর্তায় পুতুল নাচের ওপর। এ পুতুল নাচ বাংলার শিকড়ের সংস্কৃতি। লোকজ বা লোক সংস্কৃতির অন্যতম ধারক। শৈল্পিক পুতুল নাচে মানুষ তার জীবনের প্রতিফলন দেখতে পায়। যেখান থেকে এসেছে প্রবাদের সেই কথাÑ মানুষ পুতুল ছাড়া আর কী। ওপর থেকে একজন কাঠি দিয়ে নাচাচ্ছেন, মানুষ নাচছে জীবনের নানা প্রয়োজনে ঘাত-প্রতিঘাত সবকিছু মাথায় নিয়ে। পুতুল নাচের জন্ম বঙ্গীয় ব-দ্বীপের এই দেশে। বহু যুগ আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জমিদার কৌতূহলী হয়ে পুতুল বানিয়ে নাচের প্রচলন করেছিলেন। তারপর মানুষ বিনোদনের একটি মাত্রা খুঁজে পায়। ওই সময়ে সিনেমা (চলচ্চিত্র) এতটা প্রসার লাভ করেনি। নির্বাক চলচ্চিত্র দেখত মানুষ। গ্রামবাংলায় বিনোদন বলতে ছিল যাত্রাপালা। খরচ কমাতে পুতুল নাচের কারিগররা প্রথমদিকে মৃৎশিল্পী বা কুমোরদের কাছে গিয়ে পুতুল বানিয়ে নিত। মাটির পুতুলকে কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে সুতার শৈলীতে নাচানো হতো, যা ছিল অত্যধিক কঠিন কাজ। যখন দেখা গেল দর্শক এ শিল্পটি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে তখন পুতুল নাচকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য হালকা কিছু খোঁজা হলো। মিলল শোলা, কাশ ও বেত। শিল্পীরা পেয়ে গেল ইতিহাস সৃষ্টির উপকরণ। তা হলো পুতুল নাচ। পর্দার আড়ালে যিনি পুতুল নাচান তাকে ৩ থেকে ৬টি সুতা ব্যবহার করতে হয়। হৃদয়গ্রাহী করতে তালপাতার বাঁশি ব্যবহার করে কথা বলা হয়। পুতুল নাচের একটি দৃশ্য এমনÑ অন্ধকার মঞ্চে সামান্য আলোয় একটি পুতুল আরেক পুতুলের গলে মালা পরিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরেক পুতুল নাচছে সঙ্গীতের তালে তালে। লোকজ সংস্কৃতির গবেষকগণ বলেন, নাচ হলো মানুষের আবেগ প্রকাশের প্রাচীনতম বাহন। ভাষা সৃষ্টির আগে আদিম মানুষ নাচের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করত। পুতুল নাচ আমাদের বাস্তব জীবনেরই প্রতিফলন। নাট্যতাত্ত্বিক গর্ডন ক্রেইম বলেছেন, পুতুল নাচ নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাত্ত্বিকদের এতবড় উদাহরণ থাকার পরও দেশে পুতুল নাচ লোকশিল্পের মাধ্যমে বেশিদূর এগোয়নি। উল্টো ধ্রুপদী শিল্পর এ বাহনকে দিনে দিনে কলুষিত করে পুতুল নাচের আড়ালে অশ্লীল নাচ পরিবেশন করতে দেখা যায় বিভিন্ন মেলায়। শিল্পকলা একাডেমি কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এ শিল্পকে। কোন গতি নেই। লোকজের অন্যতম এ ধারকটি দেশজুড়ে গোটা ত্রিশেক দলে টিকে আছে। সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণনবাড়িয়া, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও বাগেরহাটের কয়েকটি দল শিল্পকলা একাডেমিতে মাঝে মধ্যে পুতুল নাচ পরিবেশন করে।
×