ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা ॥ কাল উঠছে একনেকে

অবশেষে আলোর মুখ দেখছে দোহাজারি গুনদুম রেল প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

অবশেষে আলোর মুখ দেখছে দোহাজারি গুনদুম রেল প্রকল্প

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ শত বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখছে দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। সার্ভে করতেই শত বছরের বেশি সময় চলে গেছে। তারপর পাঁচ বছর আগে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও উন্নয়নসহযোগী সংস্থা না পাওয়ায় এতদিন গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন আটকে ছিল। বর্তমানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়নে সম্মত হওয়ায় বাস্তবায়নে যাচ্ছে প্রকল্পটি। এটি বাস্তবায়িত হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বাস্তবায়ন দেরি হওয়ায় বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়ও। ২০১০ সালে এক হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলেও বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের চার হাজার ৯১৯ কোটি ৭ লাখ এবং এডিবির ঋণ ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা এ পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দিতে যাচ্ছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। মঙ্গলবার অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য খোরশেদ আলম চৌধুরী পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটবর্তী গুনদুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫ কিলোমিটারসহ মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ স্থাপনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, আলোচিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নের লক্ষ্যে ঋণ চুক্তি প্রক্রিয়াকরণের জন্য এডিবির তথ্যানুসন্ধান মিশন ৩১ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করেছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে ঋণ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া এডিবি ইতোমধ্যেই ঋণ দেয়ার বিষয়টি ইআরডিকে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করেছে বলেও জানা গেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৮৯০ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে চট্টগ্রাম হতে রামু এবং কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন নির্মাণের জন্য সার্ভে করেছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যে মিয়ানমার রেলওয়ে আরও বিশদ সার্ভে পরিচালনা করে। চট্টগ্রামের সঙ্গে আকিয়াবের (মিয়ানমার) রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে দোহাজারী হতে রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত ১৯১৭ সাল থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে পুনরায় সার্ভে করা হয়। সে মোতাবেক চট্টগ্রাম হতে দোহাজারী পর্যন্ত মিটার গেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কক্সবাজার হতে রামু পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৮ সালে তখনকার পূর্ববাংলা রেলওয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের জন্য সার্ভে পরিচালনা করে, যার উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলওয়ে সংযোগ স্থাপন করা। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে রেলওয়ে লাইনটি ট্রাফিক সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে জেআরটি ১৯৭৬-৭৭ সালে ডাটা সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। ১৯৯২ সালে ইকোনমিক এ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া এ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক কমিশন অধিবেশনে সম্মতিপ্রাপ্ত এশিয়ান ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট নামের প্রকল্পের আওতায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের তিনটি ইউরো-এশিয়া সংযোগ বোর্ডের মধ্যে সাউদার্ন কোরিডর অন্যতম রুট। এ বিবেচনায় সর্বশেষ দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজ নির্মাণের জন্য এক হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে (এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ৬৭০ কোটি ৭ লাখ এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে এক হাজার ১৮২ কোটি ২৮ লাখ টাকা) একটি প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই অনুমোদন দেয় একনেক। সে সময় এটি বাস্তবায়নের কথা ছিল ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু পরবর্তীতে উন্নয়নসহযোগী সংস্থা না পাওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ আটকে ছিল। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে ৯ সেপ্টেম্বর একনেক বৈঠকে সিঙ্গেল লাইন ট্র্যাককে মিটারগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ ট্র্যাকে নির্মাণের নির্দেশনা দেয়া হয়। ওই বছরই প্রধানমন্ত্রী রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় এ প্রকল্পের মাধ্যমে সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ এবং নতুন রেললাইন নির্মাণের সময় ভবিষ্যতে ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান রেখে ভূমি অধিগ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। সে অনুযায়ী বর্তমানে প্রকল্পটি সংশোধন করে পুনরায় অনুমোদনের জন্য একনেক উপস্থাপন করা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সূত্র জানায়, চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী পাঁচ বছরে ৮৫৬ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ১২৯ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে, যা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
×