ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী মেলা

শহরে লোকায়ত জীবন হস্ত ও কারুশিল্পে চোখ জুড়ানো সুন্দর

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

শহরে লোকায়ত জীবন হস্ত ও কারুশিল্পে চোখ জুড়ানো সুন্দর

মোরসালিন মিজান ॥ বৈশাখী মেলা নামে বিচিত্র সব আয়োজন। বাংলা নববর্ষে এ ধরনের আয়োজন বেশ চোখে পড়ে। তবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলা বলতে যা বোঝায়, তার কিছুটা দৃশ্যমান হয় বাংলা একাডেমি চত্বরে। প্রতিবছরই এখানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। এবারও বঙ্গাব্দের প্রথম দিন থেকে জমজমাট গোটা এলাকা। একাডেমির সহায়তায় বিসিক এ মেলার আয়োজন করেছে। এতে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন জেলার লোক ও কারুশিল্পীরা। প্রসিদ্ধ কারিগরদের নিজেদের তৈরি পণ্যসামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়েছে শতাধিক স্টল। শহুরে শৌখিন মানুষ আপন মনে দেখছেন। চলছে নানন্দিক পণ্যের কেনাকাটা। মেলার কোথাও শহুরে চাকচিক্য নেই। বরং একটা সরল একটা কোমল রূপ চোখে পড়ে। স্টলগুলোতে যা-ই সাজানো, খাঁটি। দেশজ। প্রতিদিনের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্য আছে। অধিকাংশই আদিরূপে দৃশ্যমান। কোন কোন ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার চমৎকার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প পণ্যের আরও যত গুণাগুণ, খুঁটিয়ে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। মেলায় রয়েছে মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, নক্সিকাঁথা, শতরঞ্জি, কাঠজাতপণ্য। বেশ কয়েকটি স্টলে ঐতিহ্যবাহী জামদানি ও তাঁতের শাড়ি। হাতের কাজ করা থ্রিপিস। বিছানার চাদরও বাদ যায়নি। ঝিনুকপণ্য, পুঁতির মালা পাওয়া যাচ্ছে। আছে লোকজ বাদ্যযন্ত্র। গ্রামীণ মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নাগরদোলা, বায়স্কোপ, পুতুল নাচÑ কী নেই! সব মিলিয়ে বৈশাখী মেলা। গ্রামের মেলাগুলোতে পোড়ামাটির বাসন-কোসন পুতুল খেলনা ইত্যাদির দারুণ কদর। তেমন একটি স্টলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থামতে হলো। মাঝারি আকারের টেবিলের উপর বিভিন্ন আকার ও আকৃতির মৃৎপাত্র। পেছনের দিকে কয়েকটি তাক। সেখানেও পটারি ফুলের টব ইত্যাদি। ছোট ছোট হাঁড়ি চায়ের কাপ পিরিচ আছে। তবে শহরের ফুটপাথে সচরাচর যা দেখা যায়, এগুলো তার থেকে উন্নত। প্রতিটি কাজ এত নিখুঁত যে, দৃষ্টি কাড়বেই। এখানে আধুনিক ডিজাইন। শিল্পী মনের যত খেয়াল মৃৎপাত্রের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পোড়ামাটির নান্দনিক সৌন্দর্য কেমন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আর তখন মনে হয় একেকটি মিনিয়েচার শিল্পকর্ম! ‘পোড়া মাটির নকশা ঘর’ নামের স্টলটি পরিচালনা করছেন আবুল কালাম মিয়া। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘কাজ যা দেখছেন, নিজেই করি। রায়েরবাজারে ১৯৭৫ সালে শুরু করেছিলাম। তখন সেখানে শত শত হিন্দু বাড়ি। পাল বংশের লোকেরা কাজ করেন। মুসলমানদের মধ্যে এই চর্চা নেই বললেই চলে। তাতে কী? পোড়ামাটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই কাজ শিখতে চলে যাই মরণচাঁদ পালের কাছে।’ হ্যাঁ, মৃৎশিল্পের এই কিংবদন্তি শিল্পীর কাছেই হাতেখড়ি। তথ্যটি জানার পর বোঝা হয়ে যায়, কেন এত সুন্দর কাজ। মৃৎশিল্পের আরেকটি স্টলে খুঁজে পাওয়া গেল শখের হাঁড়ি। ঠিক খুঁজে পাওয়া নয়, রঙিন হাঁড়িগুলোর দিকে এমনিতেই চোখ চলে যায়। স্টলের সামনে শিকেয় ঝুলানো হাঁড়ির গায়ে উজ্জ্বল রং। হলুদ রঙে আঁকা শরীরের ওপর লাল ও সবুজের চিত্রকর্ম। ফুল-লতা-পাতার নক্সা। রাজশাহীর শিল্পী সঞ্জয় কুমার পাল স্টলে বসেই কাজ করছিলেন। তিনি জানান, বহুকাল ধরে তারা শখের হাঁড়ি তৈরি করে আসছেন। এক সময় কুটুমবাড়িতে মিষ্টি পিঠা ইত্যাদি পাঠাতে শখের হাঁড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন সেই ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি এখন গৃহসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন আকারের হাঁড়ি একটির উপর আরেকটি বসিয়ে সেট তৈরি করা হয়েছে। যার যেটা পছন্দ, কিনছেন বলে জানান শিল্পী। শোলাশিল্পের অবস্থা আরও খারাপ। তবু পেশাটি ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। একটি স্টলে গিয়ে দেখা যায়, শোলায় তৈরি গোলাপ-বেলি-শাপলা ফুল। পাখি কয়েক প্রজাতির। বানর, কুমিরও আছে। শোলা কেটেই তৈরি করা হয়েছে গরুরগাড়ি। বরের বিশেষ টোপরটিও দারুণ সুন্দর করে গড়েছেন। স্টলে বসে প্রবীণ শিল্পী শঙ্কর মালাকার বললেন, জন্মের পর থেকে এ কাজে আছি। ছেলে রামপ্রসাদও শিখেছে। এভাবে যে কয়দিন পারা যায়, কাজ করে যেতে চান বলে জানান তিনি। মেলায় ধামরাই থেকে এসেছেন দিলীপ সরকার। কাসা ও পিতল শিল্পের নিদর্শন দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন তিনি। মেয়েদের হাতের বালা, গলার হার গড়েছেন তিনি। বেশ আকর্ষণীয়। এখনও এসব কেউ পরে? জানতে চাইলে আত্মবিশ্বাসী কারিগর বলেন, আমি তো কম দামে বিক্রি করি। আমার জিনিসই আড়ং কুমুদিনী থেকে অনেক টাকায় মেয়েরা কেনে। দেশীয় তাঁতের শাড়ি, জামদানি ও নক্সিকাঁথা বেশ কয়েকটি স্টলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছেন পারভীন আক্তার। তার সংগ্রহে দারুণ সব নক্সিকাঁথা। বললেন, ‘অনেক শ্রম ঘামে একেকটি কাঁথা হয়। আন্তরিক না হলে কাজটি করা যায় না।’ এ স্টলের কাঁথা উল্টে পাল্টে দেখানোর পর যে দাম হাঁকা হয়, তাকে সামান্য বলবেন যে কোন সৌখিন মানুষ। বাদ যায়নি লোকজ বাদ্যযন্ত্র। কুষ্টিয়া থেকে একাধিক কারিগর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছেন। আর বাঁশি দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন ঢাকার এক শিল্পী। বাঁশের বাঁশি। অনেক জাত। আকারে ছোট-বড়-মাঝারি। মুখ বাঁশি আছে। আছে আঁড় বাঁশি। কারিগর এলিফ্যান্ট রোডের লাল মিয়া। বললেন, ‘বাঁশি যে কেউ বাজাতে পারে না। মনে সেই দরদ থাকা চাই। গ্রামীণ মেলা যেহেতু, মিষ্টি, মুড়ি-মুড়কি থাকবেই। চোখে পড়ল সোনারগাঁওয়ের লাঙ্গলবন্দ থেকে আসা কারিগরদের বড় একটি স্টল। এখানে কদমা, বাতাসা, মোড়ালি, আঙ্গুরী, আমিরতি, উখড়া, নিমকি, নকুল দানা, লাড্ডু। এভাবে হরেক আয়োজন। ঐতিহ্যবাহী মেলা ঘুরতে ঘুরতে গ্রামে চলে যাওয়া যায়। পণ্যসামগ্রীর দামও কম। অল্প টাকায় ভরপুর কেনাকাটা করা যায়! সময় আছে, ঘুরে আসতে পারেন আগ্রহীরা। দশ দিনব্যাপী মেলা চলবে শনিবার পর্যন্ত।
×