ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বিধিনিষেধের উৎসব পহেলা বৈশাখ?

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৫ এপ্রিল ২০১৬

বিধিনিষেধের উৎসব পহেলা বৈশাখ?

‘প্রাণে খুশির তুফান’ লাগার দিনে ভয়ের করাল থাবা সম্প্রসারিত হচ্ছে সর্বত্র। অজানা শংকায় জাগ্রত হচ্ছে ভীতির সংস্কৃতি। আগাম ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের কাজটি চমৎকার সুনিপুণভাবে যে করা হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। বিধিনিষেধের কালো হাত এসে থাবা বসাচ্ছে বুঝি বাঙালীর প্রাণে প্রাণে যোগ হবার উৎসবে। যখন উৎসবের প্রতিপাদ্য হয়, ‘অনেক আলো জ্বালাতে হবে মনের অন্ধকারে’, তখন চারপাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার কত কসরত যে দেখা যায়, অসভ্যতা, বর্বরতা, অভব্যতা কদর্য করে তোলে উৎসবকে। আর এসব থেকে রেহাই পাবার পন্থা হিসেবে প্রাণ প্রবাহকে গুটিয়ে নেয়ার জন্য চাপ তৈরি করা হয়, তখন স্পষ্ট হয়, মনের অন্ধকার ঘুচবে না। বরং কলুষতার কালোছায়া ছড়িয়ে পড়ে যেন সর্বত্র। ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’ বলে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক যে গেয়ে উঠতেন আসরে, অভয় নিয়ে লিখতেন নিবন্ধ প্রবন্ধ, কলাম, তখন সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়াতো নাগরিক বাঙালী। সেই অভয় বাণী শোনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন বিকেল শেষের সন্ধ্যা এবং রাতেও উৎসবের আলোকের ঝর্ণাধারায় রেঙে ওঠার আয়োজন। আর এখানেই বিদ্ধ করা হয়েছে চোখ রাঙানি দিয়ে ভয়কে বদ্ধমূল করে তোলায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে এত গাইলেন সঙ্কোচের বিহ্বলতা কাটিয়ে ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান’। সেই গান ভয়ার্ত কণ্ঠে গাইতে হবে উৎসবের মঞ্চের নিচে বসে! বাঙালীকে বাঙালী হয়ে বেঁচে ওঠার পথটি দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর উৎসব, সংস্কৃতি সবকিছুকে রক্ষা করে তাকে বিকশিত করার জন্য যে সংগ্রাম, তা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের সকল শ্রম, কর্মনিষ্ঠতা ও কুশলতা মিলিয়ে। বাঙালী অন্তঃপ্রাণ শেখ মুজিব সেই পঞ্চাশ, ষাটের দশকেও দলীয় কার্যালয়ে আয়োজন করতেন বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানমালার। মুড়ি-মুড়কি খাওয়া হতো। তাঁর সুদূর প্রেরণা আর সংগ্রামী চেতনার বাতাস দোলায়িত হয়েছিল ছায়ানটেও। এই ছায়ানটের হাত ধরেই নগরজীবনে বৈশাখ এসেছিল কেবল উৎসবের আমেজ নিয়ে নয়, দ্রোহের-প্রতিবাদের, স্বাধিকারের ও স্বাধীনতার আবাহন নিয়েও। বাঙালীর যে স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রাম, তাতে প্রাণ প্রবাহ যুগিয়েছে, আন্দোলনকে তীব্রতর করেছে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার দীপ্ততায়। পাকিস্তানী জান্তা শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই ষাটের দশকের শেষ দিকে এসে রমনা বটমূলে ছায়ানট যে আয়োজন করেছিল বৈশাখী উৎসবের, গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে তা ডালপালা ছড়িয়েছে এমনভাবে যে, সারাদেশেই বৈশাখী উৎসব আর মেলায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তা সব বাঙালীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এদিন তাই বাঙালী গেয়ে ওঠে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/ এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।’ সকল না পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে-মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি করে তুলতেই ফিরে ফিরে আসে পহেলা বৈশাখ। নতুন স্বপ্ন, উদ্যোগ ও প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো নতুন বাংলা বছরেরও শুরু হয় যাত্রা। বৈশাখের নব প্রভাতেই বাঙালী তাই কায়মনে প্রার্থনা করে, যা কিছু ক্লেদাক্ত, গ্লানিময়, যা কিছু জীর্ণ বিশীর্ণ, দীর্ণ, যা কিছু পুরনো-তা বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে হয় যেন ছাই। গ্রীষ্মের এই তাপস নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় নিয়ে যায়, দূরে যায়, দূর-দিগন্তে মিলায়। বর্ষ বরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। গ্রীষ্মের অগ্নিজিহ্বা হয়ত বাতাসে লকলক করে উঠবে গেয়ে। উগড়ে দেবে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে অগ্নিবরণ নাগ-নাগিনীপুঞ্জ ও তাদের সঞ্চিত বিষ। তারপরও বাঙালী এই খরতাপ উপেক্ষা করে মিলিত হয় তার সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের প্রতিটি পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায় অনুষ্ঠান জুড়ে থাকে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসবমুখরতার বিহ্বলতা। কারণ বৈশাখ মানেই বাঙালীর আনন্দের দিন। বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসবই বাঙালীকে ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা দেয়। সেই সঙ্গে করে ঐক্যবদ্ধ। নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বৈশাখ কেবল আনন্দের নয়, প্রতিবাদেরও মাস। বৈশাখ অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াবার শক্তি যোগায়। নববর্ষের প্রথম দিন বদলে যায় ঢাকা, বদলে যায় দেশ। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় বর্ণবহুল হয়ে ওঠে। কাকডাকা ভোর থেকেই বাঙালী সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দপিয়াসীরা পথে নামে। কায়মনে বাঙালী হয়ে ওঠার বাসনা জেগে ওঠে সবার মনে। বর্ণাঢ্য উৎসবের রঙে রেঙে ওঠার দিনটি প্রাণে প্রাণে প্রবাহ যোগায়। কিন্তু এই উৎসবকে মলিন করে দিয়ে ধর্মান্ধ, বাঙালী বিরোধীরা নানা ঘটনাও ঘটিয়েছে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণে বোমা হামলাও হয়েছে। গত বছর টিএসসিতে কনসার্ট চলাকালে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। মেয়েদের প্রতি অশোভন আচরণও করা হয়েছে। আর এমন ঘটনায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ নয়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই বাঙালীর প্রাণে প্রাণে যোগ ঘটে যে উৎসবে, সেই উৎসবকে সঙ্কুচিত করে তোলার প্রয়াস যখন ঘটানো হয়, তখন জাতিসত্ত্ব¡ার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ‘আমি ভয় করবো না, ভয় করবো না/ দু’বেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না’- বলে বিশুদ্ধ সুরে ওয়াহিদুল হক গান গাইতেন, তখন প্রবীণ-নবীন সকলের মধ্যে এক দুর্দান্ত সাহস এসে ভর করতো, উৎসবের রঙিন আলোয়। কিন্তু এখনকার দ-মু-ের হর্তাকর্তারা দু’বেলা মরার মতো নিষ্প্রাণ হয়ে ভয়ের নৌকায় জাতিকে চড়িয়ে মাঝনদীতে ডুবিয়ে মারার জন্য যে ভয়ভীতির দরোজা ‘সিসিম ফাঁক’ বলে খুলে দিচ্ছেন আগাম, তাতে উৎসব ভীতির শকুনেরা ওড়াউড়িই করবে। তাদের এই আগাম ভয়-ডর ছড়ানো অবদমিত করতে পারে বাঙালীর প্রাণ প্রবাহকে। উৎসবহীনতার এক বদ্ধতার ভেতর থুবড়ে পড়ায় বাধ্য করতে পারে জাতিকে। সশস্ত্রযুদ্ধে জয়ী জাতি এসব ভয়ভীতিকে চিরকাল তুচ্ছ করে এসেছে। তারা এসব মানবে কেন? চারণকবি মুকুন্দ দাস সেই স্বদেশী আন্দোলন যুগে গাইতেন, ‘ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙে।’ এই যে ভয়হীনতার দিকে মানুষকে নিয়ে যাওয়া, ভীতিহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠা, সাহসের বরাভয় কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফেরা, সেই বাঙালী তার উৎসবকে গোধূলি লগনে সমাপ্ত করে দেবে- এমন বাধ্যবাধকতা যারা আরোপ করে, তাদের ‘নির্ণয় ন জানি’। কিন্তু এই দ-মু-ের হর্তাকর্তারা ভয়ের আবডালে নিজেদের আড়াল করার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করতেই পারেন। কিন্তু ‘বাঙালীকে আর দাবায়ে রাখবার পারবা না’ বলে যে উচ্চারণ ৪৫ বছর আগে বাঙালী শুনে এসেছে, সেই তাকে দাবানোর কোন অপচেষ্টাই কার্যকর হতে পারে না। উৎসবের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে পুলিশের স্বল্পতার কারণে। নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন আশঙ্কা থেকে মুখোশপরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তো পারে, ছাত্রছাত্রী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীদের সমন্বয়ে ব্রিগেড গঠন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে। অনুষ্ঠানমালা রাত ৮টা পর্যন্ত চালানো যেতে পারে সকলের সমন্বিত সহযোগিতায়। প্রাণের উচ্ছ্বাসে, নাড়ির টানে একে অপরের হাতে হাত রেখে সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে নববর্ষ উদযাপন করবে বাঙালী- এমনটাই হবার কথা। কিন্তু ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে উৎসবের প্রাণ ভ্রমরাকে গলাটিপে মেরে ফেলার এই আয়োজন ভয়ঙ্কর। ভীতিমুক্ত উৎসব চাই সর্বত্র।
×