ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যত কথা

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ৪ এপ্রিল ২০১৬

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যত কথা

অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে স্কুলে ট্রাফিক আইন শিক্ষা জরুরী বলে মন্তব্য করেন। কিছু দিন আগে বিশ্ব নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও দিনটি পালিত হয়েছে, বলা যায় মহাসমারোহে, কেননা এ উপলক্ষে র‌্যালি হয়েছে, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, বিশিষ্টজনদের নিয়ে আলোচনা সভা কিংবা পত্রিকায় গোলটেবিল বৈঠক হয়েছে। এ গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে আলোচনায় অতি সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত তথ্যাবলী উঠে এসেছে। সংবাদপত্রের পাঠকের মতামতও তথ্য সমৃদ্ধ ও চিন্তা উদ্দীপক। তবে তাদের আলোচনা থেকে ত্বরিত সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত যে, চালকের কারণেই সড়কে এত মৃত্যু; চালক ছাড়াও সড়ক, জনপদ, মহাসড়ক, রাস্তা ও অলিগলির পথে সংঘটিত দুর্ঘটনার নায়ক অনেকেই। পরিতাপের বিষয়, এই দুর্ঘটনার সংখ্যা কিংবা কারণাদি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান মেলা বড় দুষ্কর। মনে হচ্ছে সমস্যাটা সাধারণ মানুষের এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিংবা সমস্যাটা ইলিয়াস কাঞ্চনের, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের ধরিত্রীর বুকে বেঁচে থাকা বন্ধুদের কিংবা জগলুল আহমদ চৌধুরীর সুহৃদ হিসাবে আমার কিংবা সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। আসলে সমস্যাটি সকলের যারা দুর্ঘটনা ঘটায় কিংবা দুর্ঘটনার শিকারে পরিণত হন। তন্মধ্যে মৃত্যুবরণকারীগণ বরং বেঁচে যান, কেননা তারা সব ভাবনা, সব চিন্তা এবং যাতনার উর্ধে চলে গেছেন, তবে তাদের পরিবার দুঃসহ জীবনযাপন করেন। আর দুর্ঘটনায় পঙ্গুগণ এক ধরনের করুণাশ্রয়ী অসহায় জীবনযাপন করেন। প্রায়ই শুনি একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের কান্না, তার শিকার সাধারণ মানুষ, প্রায়শ পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিটি। তাদের সংখ্যাটা কত সেটা নিরূপিত হতো যদি দুর্ঘটনার শিকার, পরিণতি কিংবা কারণগুলো উদঘাটন করা যেত। এ ব্যাপারে সরকারী কর্তৃপক্ষ কতটা গিয়েছে জানি না। কিন্তু একটি গবেষণা সংস্থার মতে, দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে রাস্তার ব্লাইন্ড স্পট, অদক্ষ চালক, সড়কের তুলনায় অধিক সংখ্যক গাড়ি, বেপরোয়া গতির গাড়ি রাস্তায় জ্যামিতিক ত্রুটি, নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, পথচারী ও যাত্রীদের অসাবধানতা, বিপরীতমুখী যানবাহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ, রেলের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং ইত্যাদি। সংবাদপত্রের বদৌলতে অর্থাৎ সাংবাদিকের বদৌলতে কিংবা গোলটেবিল বৈঠকের সৌজন্যে কিংবা বিদগ্ধ পাঠকের মতামতের ভিত্তিতে যে সব কারণ এসে যায় সেগুলো হলো : চালক মালিকের অসাবধানতা, আইনী দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগকারীদের দুর্নীতি, চালক ও মালিকের রাজনৈতিক সংশ্রব ও সে কারণে অপরিমিত শক্তি, যানবাহনে অডিও সিডি বাজানো বা মোবাইল ফোন ব্যবহার, চালকের মনোযোগ ও দৃষ্টিভ্রম ঘটানো যাত্রী, রাস্তায় গতিরোধকের অভাব, থাকলেও তা অমান্য করার বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির, সড়ক ও জনপদের ওপর বা পাশে হাট-বাজার স্থাপন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কের বেহাল দশা, রাস্তা ব্যবহারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার অভাব, চালক স্বল্পতা ফলত চালক ও হেলপারের আট ঘণ্টার বদলে কখনও আট-চল্লিশ ঘণ্টার কাজের চাপ, ফুটপাথের অভাব কিংবা ফুটপাথকে দোকানপাটের স্থান হিসেবে ব্যবহার, চিন্তাগ্রস্ত চালক ও হেলপার, ঝুঁকিপূর্ণ মোড়, ফুট ওভারব্রিজের অভাব, ওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহারে অনীহা, রোড ডিভাইডার ডিঙ্গিয়ে রাস্তা অতিক্রম, যত্রতত্র ওভারটেকিং ও ক্রসিং, বিপরীত রাস্তায় যান চলাচল, একই রাস্তায় দ্রুতগামী ও শ্লথগামী যানবাহন ব্যবহার, ট্রাফিক আইন মানতে অনীহা, ট্রাফিক পুলিশের অবহেলা কিংবা দুর্নীতি, বিআরটি-এর দুর্নীতি, অদক্ষ চালকের স্ফীতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ভুয়া লাইসেন্স, দালাল চক্র, অবৈধ পার্কিং, আইন প্রণয়নে অনিশ্চয়তা ও প্রয়োগে বৈষম্য বা অনীহা, দুর্ঘটনায় গুরু অপরাধে লঘু দ-, দুর্ঘটনার সাক্ষী-সাবুদ না পাওয়া, দুর্বল চার্জ গঠন, তিন চাকা বা মিশুক, নসিমন, করিমনের অবৈধ ব্যবহার, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন এবং এ ব্যাপারে গণপ্রতিনিধিদের পরোক্ষ উস্কানি, সড়ক-মহাসড়কে নতুন রীতির প্রবর্তন, যেমন দ্রুতগামী লেনে শ্লথগামী বাস ট্রাক চালানো, হাত সিগন্যাল, ট্রাফিক লাইটের অব্যবহার বা অপব্যবস্থা, অপ্রশস্ত, ভাঙ্গাচুড়া রাস্তা, নিয়ন্ত্রণহীন গতি, যাত্রী পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ওভারটেকিং, রাস্তা ব্লক করা, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠা-নামা করা, অনুমোদিত স্থানে যাত্রী ওঠা-নামা বা পার্কিং, দুর্বল তদারকি বা মনিটরিং, পার্কিংয়ের জায়গা দোকান হিসাবে ব্যবহার, যেখানে সেখানে বাসস্ট্যান্ড, নৌ ও রেলপথের স্বল্পতা, আন্ডার পাস ও ওভারপাসের অপব্যবহার, রাস্তাঘাটে মিছিল-মিটিং, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, পুলিশের কর্মোদ্দীপনার অভাব, গণমাধ্যমের নির্লিপ্ততা, দৃষ্টিরোধকারী, সাইন বোর্ড ও স্থাপনা, ভারি যানবাহনের ওভারব্রিজ ব্যবহার, যানবাহন স্বল্পতা ইত্যাদি। দুর্ঘটনার কারণগুলো গুচ্ছভাবে সাজালেও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে উদঘাটিত হবে যে দুর্ঘটনার জন্য সাধারণ রাস্তা ব্যবহারকারী, যাত্রী, চালক, মালিক, বাহন, রাস্তার অবস্থান, প্রশস্ততা, পুলিশ, বিআরটিএসহ অনেকেই দায়ী। তবে কার দায়িত্ব কতটুকু, এটা উদঘাটন করা যাবে যদি সঠিক কারণাদির গুরুত্ব খুঁজে বের করা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের অভাবে তার সমাধান নিয়ে আছে নানা মুণির নানা মত। তবে এ কথা অস্বীকার করার জো নেই এটা এমন একটি সমস্যা যা জাতীয় উৎপাদনকে ১.৬ শতাংশ কমিয়ে রাখে। তাই সমস্যাটির আশু সমাধান করলে জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ৮.৬ শতাংশ। অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে দুর্ঘটনা হ্রাসে নিম্নোক্ত পরামর্শগুলো তুলে ধরছি : ১.কোন অবস্থায় অদক্ষ, অশিক্ষিত ও আনুষ্ঠানিক ট্রেনিংবিহীন চালক নিয়োগ দেয়া চলবে না। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে দেশে গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখ আর কোনরকমে প্রশিক্ষিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৬ লাখ। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ৮ ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করে। কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা হচ্ছে প্রচলিত রীতি। তাই প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র বৃদ্ধি আবশ্যক। পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান সরকারী কিংবা বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে পিপিপি-এর সুযোগ দেয়া যেতে পারে। ২.আইন সংশোধন প্রয়োজন। কিছু আইন বহু পুরনো, আইনে দোষীদের পর্যাপ্ত শাস্তির বিধান রাখতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পূরণের আওতায় আনতে হবে। অপরাধী শনাক্ত না হলে দুর্ঘটনার শিকারদের সরকারী কোষাগার থেকে ক্ষতি পূরণ দিতে হবে। সুখের বিষয় যে বিআরটিএ আইনটি অনুমোদন পেয়েছে এবং আর টি এ্যাক্টটি শীতকালীন সংসদ অধিবেশনে পাস হবে বলে আশা করা যায়। টঘ ও ডঐঙ-এর উবপধফব ড়ভ অপঃরড়হ-এর অনুগামী হওয়া ছাড়া সাধারণ জীবন রক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে না। ৩.দেশে আইন আছে, হতে পারে তা পুরনো কিন্তু তারও সঠিক প্রয়োগ নেই। অনেক সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। আর যানে ভরা রাস্তায় আইন প্রয়োগ করতে গেলে যানজটের বদৌলতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক সময় আইন প্রয়োগ সংস্থা নি¤œবিত্ত ও উচ্চ বিত্তের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন কারণে উদার। তারা একজনকে অনুকম্পা করে আর অপর জনকে সমীহ করে ছেড়ে দেয়। রাস্তার উল্টোদিক দিয়ে দুই শ্রেণীর মানুষ যানবাহন চালিয়ে বরং যানজটের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা সৃষ্টিই করেন। এসব ক্ষেত্রে জীবনহানি না হলেও সম্পদহানি ও অহেতুক সময়ক্ষেপণ হয়েই থাকে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান ও সংঘবদ্ধরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি চালক সংঘবদ্ধ শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ কাজটি করে থাকে। ৪.আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিআরটিতে অধিক সংখ্যক সজ্জন ও সৎ ব্যক্তি বসাতে হবে। যত আইনই করা হোক না কেন, প্রায় সময় সেসব প্রয়োগকারীর আয় উপার্জন ও ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে দেয়। আমি সংবাদপত্রে দেখলাম ও দেখছি যে ট্রাফিক পুলিশ নির্লজ্জভাবে ঘুষ নেয়, বিআরটিতে দালাল ও ঘুষের দৌরাত্ম্য সীমাহীন। মন্ত্রী এ ব্যাপারে যতটা উদ্যোগী, অন্যরা তার দশ শতাংশ নিবেদিত হলে সমস্যার প্রচ-তা কমে আসবে। সড়ক বিভাগের কর্মচারীদের সময়-অসময়ে রাস্তায় নামিয়ে মন্ত্রী রাস্তার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেন না, বার বার প্রয়াশ বিফল হলে মানুষের মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে এবং এক সময়ে হাল ছেড়ে দেবার পরিস্থিতি জন্ম হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ক্ষমতাসীনদের অহেতুক হস্তক্ষেপের কারণে হাল ছেড়ে দেন। তারা স্থানিক অনিয়মকে নিয়ম বলে মেনে নেন। ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপে তারা লাইসেন্সবিহীন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির চালক ও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। সড়ক ও জনপদের ওপরে কিংবা পাশের দোকান পাট তুলে দিতে তারা অনেক সময় অক্ষম। মিশুক, নসিমন, করিমন বা ত্রিচক্রযান বন্ধ করতে তারা অপারগ, কেননা, সে সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে। এক সময়ে তারা ঠিক লোক দেখানো দায়িত্ব পালন করেন কিংবা ক্ষমতাহীনদের ওপরে জাপটে পড়েন; কর্তব্য পালনে পরাকাষ্ঠা দেখান। দুর্ঘটনার ভুক্তভোগী অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের দুর্বল ও অসহায় অংশ, বিত্তহীন তো বটে। তাদের কথা শুনবে কে? তাই পঞ্চাশ ভাগ অভিযোগ অশ্রুত থেকে যেতে পারে। ৫. সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ‘জন’ বলতে সাধারণ নাগরিক নয়, সকল শ্রেণীর মানুষ বিশেষত গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। গণসচেতনতার অংশ হিসাবে পাঠ্য বিষয়ে সড়ক ব্যবহার নীতি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আমাদেরকে স্কুলে শিখানো হতো ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে আর ফুটপাথ না থাকলে রাস্তার ডানদিক দিয়ে হাঁটতে। তাতে পথচারী হিসাবে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। ডানদিক হাঁটতে গেলেও এখন দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়, কেননা ক্ষমতাবানরা উল্টো পথে যান চালান। আমাদের শেখানো হতো লালবাতি জ্বললে গাড়ি থামবে আর তোমরা রাস্তা অতিক্রম করবে। যখন গাড়ি চালাবে তখন পথচারীদের দাবি আগে মিটাবে, রাস্তার বাম পাশ দিয়ে গাড়ি চালাবে, দ্রুতগামী লেন দিয়ে শ্লথগামী যান চালাবে না। এখন পুলিশের সামনেই এসবের ব্যত্যয় ঘটছে। শ্রমিক ও তাদের নেতারা পুলিশের চেয়ে ক্ষমতাবান। ৬. আইনগত কিছু সংশোধনীর পরও মামলা মোকদ্দমা সুরাহার বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতি বের করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অউজ অর্থাৎ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা চালু করা যায়। তবে যানবাহনের মালিক ও চালক এখন বেকায়দায় ক্ষমতাবান। সে তুলনায় ক্ষমতায়িত জনগণের সংখ্যা কম। তাই কতিপয় ক্ষেত্রে জনগণকে ক্ষমতায়িত করে ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে ইলিয়াস কাঞ্চনদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাদের স্বউদ্যোগে একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। প্রতিবছর কয়েক হাজার পরিবার-পরিজন স্বজনকে হারায় এবং যে কয়েক হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে তাদের একটি শতাংশকেও যদি তার পতাকায় শামিল করতে পারেন তাহলে তা হলো এক বিশাল শক্তি, গণনা করা বা গুরুত্ব দেবার মতো শক্তি। তখন তারা অন্যত্র সুসংগঠিত শক্তিকেও মোকাবেলা করে তাদের নিজস্ব দাবি দাওয়া আদায় করে নিতে পারবে। ২২ বছর যা সম্ভব হয়নি দু’বছরে তা সম্ভব হতে পারে। সাধারণ মানুষ তো বটে, আমার অসহায়ত্বের একটি নমুনা দিচ্ছি। আমার মনে দাগ কেটে আছে। একবার একটি ট্রাক আমাকে স্ত্রী সমেত রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। আমি ট্রাফিক পুলিশের কাছে একটু উচ্চৈঃস্বরে অভিযোগ করলাম। তিনি কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি মরে গেছেন যে এত জোরে চিৎকার করছেন, সামান্য ব্যথা পেয়েছেন আর এত চিৎকার। আমার পরিচয় জেনে ট্রাকটি থামিয়ে দেয়া হয়েছিল। পয়সা খেয়ে আরেকজন তা ছেড়ে দিল। আর আমাকে বলা হলো যে ট্রাকটির মালিক হলেন এক ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং তাদের করণীয় কিছু নেই। ৭.অবস্থার পরিবর্তন আবশ্যকীয়। অপঃরড়হ ড়হ জড়ধফ ঝধভবঃু দশককে কার্যকর করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে সড়ক নির্মাণ বাজেটের পাঁচ ভাগ তার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। প্রতিটি অঞ্চলে কমিটির শাখা গঠন করতে হবে এবং চুয়াল্লিশ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সড়ক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে। ৮.পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও হাইওয়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র শাখায় উন্নীত করে তার সার্বিক দায়িত্ব সড়ক ও সেতু মন্ত্রীকে দেয়া যেতে পারে। ৯. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হলে বড় বড় শহরের ওপর চাপ কমবে এবং সে অনুপাতে সড়ক দুর্ঘটনাও কমবে। রেল ও নদী যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও কিছু বেশি অর্থ বরাদ্দ এবং মনোযোগ দিলে রাস্তা বা সড়কের ওপর চাপ কমে আসবে। শহরের পাশ ঘেঁষে উপশহর গড়ে তুলেও অনেকটা চাপ কমানো যাবে। সাম্প্রতিক ঘোষিত এলাকাভিত্তিক শিশু ভর্তি ব্যবস্থা নগরের যানবাহন চাপ কমিয়ে দুর্ঘটনা কমাতে সাহায্য করবে। এ জাতীয় চিন্তাভাবনা কার্যকর করলে জীবন, সম্পদ ও সময় সাশ্রয় হবে। ১০. জনপথে সবচেয়ে দ্রুতগামী লেন দিয়ে সবচেয়ে শ্লথগামী বাস ও ট্রাক অহরহ চলছে। লাল-সবুজের তোয়াক্কা নেই, পুলিশের মর্জি মোতাবেক লাল দেখলে চলতে হবে আর সবুজ দেখলে থামতে হবে। অথচ আমাদের শেখানো হয়েছিল লাল মানে থেমে যাবে আর সবুজ মানে সামনে চলতে থাকবে। আইন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত আইন ছোটবেলা থেকে শিখানো উচিত। ১১. সড়ক দুর্ঘটনা রোধের ক্ষেত্রে তো বটেই, আমাদের সব সমস্যার মূলে অবস্থান করে দুর্নীতি। দুর্নীতি রোধের একটি পদক্ষেপ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যায়। নিদেনপক্ষে সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সময়ে চাকরিজীবীর ব্যক্তিগত আর স্থায়ী সম্পদের বিশদ বিবরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবার ও শ্বশুরপক্ষীয়দের আয়-উপার্জন ও সহায় সম্পদের হিসাব নিতে হবে। প্রতিবছর নিয়োগপ্রাপ্তদের সহায় সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ নিরূপণ করতে হবে। ঐ সম্পদে বৃদ্ধি বা হ্রাসের কারণটাও উদঘাটন করতে হবে। সেটা করবে কে? একটা বড় প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি কমাতে কিংবা রোধে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে দুর্নীতি রোধে কাঠামোগত বিন্যাস বা পুনর্বিন্যাস আবশ্যক। পিপিপি প্রবর্তন করলে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। ইতিমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রেষণা বৃদ্ধির প্রয়াস নেয়া হয়েছে। চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন আনা হয়েছে। বেতন কম করে হলেও শতভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে; অর্থাৎ সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের অনুকরণে সরকারী চাকরিজীবীর পদটিকে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান করা হচ্ছে। তাই ভেবে চিন্তে দুর্নীতির আশ্রয় নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ১২. ৭৬ ভাগ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মুখোমুখি সংঘর্ষকে দায়ী করা হয়। ডিভাইডার না থাকায় বড় যানগুলো ওভার টেকিং করতে গিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটায়। অতীতে প্রাইভেটকারকে সাইড দিতে হেলপার চালককে সতর্ক করতে বলত ‘প্রাইভেট, প্রাইভেট এখন বলে প্লাস্টিক-প্লাস্টিক’। এখন ইচ্ছে হলে প্লাস্টিককে সাইড দেবে, না হলে দেবে না, সাইরেনযুক্ত গাড়িকে এখনও কিছুটা তোয়াক্কা করে। ফলে অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করেও এমনিতর গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। এখন আমরা সবাই রাজা। তাই অন্যের প্রতি সম্মান-সমীহ জোর করে আদায় করতে হয়। বাসের ড্রাইভার ও হেলপারগণ আজকাল কাউকে ভ্রƒক্ষেপই করে না। বলতে গেলে তারা যাত্রীদের সঙ্গে শুধু দুর্ব্যবহার নয়, প্রতিনিয়ত তাদের ঠকিয়ে যায়। সিটিং সার্ভিস বা বিরতিহীন বলে গাড়িতে তোলা হয়। কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় গাড়িটা সিটিং সার্ভিসের বদলে চিটিং সার্ভিস আর বিরতিহীন মানে পথে ঘাটে যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করানো ও যেখানে সেখানে থামার ব্যাপারে বিরতিহীন। এখন কদাচিৎ গাড়িকে স্টপেজে থামতে কিংবা যাত্রী তুলতে দেখা যায়। রাস্তার মাঝখানে ওঠানো-নামানো, ট্রাফিক লাইটের সামনে ওঠানো-নামানো অনিয়ম নয়, নিয়মে পরিণত হয়েছে। এমনভাবে জগলুল চৌধুরী প্রাণ দিলেন। এ সবই তো সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা ও ব্যাপকতা বাড়িয়ে দেয়। এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হরতাল, ধর্মঘট, মারধর ইত্যাদি অনাচার মালিকের উস্কানিতে শ্রমিকরা করে থাকে। তারা রাষ্ট্রশক্তি অপেক্ষা নিজেদের যতটা শক্তিমান ভাববে, ততটা দুর্ঘটনা ঘটাতে ভ্রƒক্ষেপ করবে না। তাই এ ব্যাপারে জাপানের মতো এক ধরনের সামাজিক গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রয়োজন। বর্তমান সরকার তা করতে পারবে বলে আমি আশ্বস্ত। ১৩.আমাদের পরিকল্পিত রাস্তা ও পরিকল্পিত নগরায়ন করা প্রয়োজন। হিসাব মতো নগরীতে ২৫ শতাংশ ভূমি রাস্তার জন্য থাকবে, আমাদের আছে ৭ ভাগ। যারা ব্যক্তিগত পরিবহন বা ট্যাক্সি ব্যবহার করে তাদেরকে সংযত করতে বিশেষ বিশেষ দিনে কিংবা সময়ে অতিরিক্ত মাসুলের বোঝা বইতে হবে। সিঙ্গাপুরের মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যানজটও কম, দুর্ঘটনাও কম। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষণীয় রয়েছে। রাস্তার পরিমাণ ২৫ শতাংশ উন্নীত করা সম্ভব না হলেও ৭ ভাগ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। নগরীর ৭০-৮০ শতাংশ রাস্তা চার ভাগের এক ভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি দখল করে চলে। একই পরিবারে একাধিক গাড়ি এখন হরহামেশা দেখা যায়। বড় গাড়িগুলোকে নিরুৎসাহ করার উপায় বের করতে হবে। একাধিক গাড়ির মালিককে একদিন জোড় সংখ্যা ও অন্যদিন বিজোড় সংখ্যক গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। ভারি যানবাহনগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পথে বা লেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। কোন অবস্থায় তারা যেন নিষিদ্ধ পথ ব্যবহার না করে ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৪. ফুটপাথে অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে ট্রাফিক পুলিশসহ রাজনৈতিক চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। সড়ক ও মহাসড়কের পাশে ব্যারিকেড দিয়ে সমস্যা সমাধানের নামে সমস্যা সৃষ্টি না করে হাট বাজারগুলো উঠিয়ে দিতে হবে। মহাসড়কে শ্লথগামী রিক্সা, বেবিট্যাক্সি ও ফিটটেসবিহীন মিশুক, নসিমন, করিমন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ১৫.পরিসংখ্যান ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। গত ২১-২২ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৫ হাজার, মামলা হয়েছে ৮৩ হাজার, আর শাস্তি হয়েছে মাত্র একজনের। এ পরিসংখ্যানটা তেমন নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। অন্যান্য পরিসংখ্যান নিয়ে মহাবিতর্ক আছে। এ সব বিতর্ক নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদেরকে সঠিক পরিকল্পনা, কর্মব্যবস্থা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করতে হবে। ১৬.প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ মোতাবেক সড়ক দুর্ঘটনা রোধে স্কুলে ট্রাফিক আইন শিক্ষা জরুরী ভিত্তিতে দিতে হবে। উপরেল্লিখিত সব আবার আচরণনির্ভর। তাই আচরণে মৌলিক পরিবর্তনে ঈযধহমব গধহধমবসবহঃ-এর আশ্রয় আবশ্যক ও সেজন্যও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান অত্যাবশ্যক। গুরুত্ব অনুসারে সমস্যাগুলোর ক্রমান্বয়ে সমাধান সম্ভব। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
×