ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খায়রুল বাসার নির্ঝর

শিল্পী এবং শিল্পের ওপর আঘাত

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১ এপ্রিল ২০১৬

শিল্পী এবং শিল্পের ওপর আঘাত

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর স্মরণ অনুষ্ঠানে ‘নবান্ন’খ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য যে কথাটি বলেছিলেন, সেটি ভাবায় বারবার, ‘ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে।’ খুনের ধরন বিভিন্ন রকম হয়। খুন বিভিন্ন উপায়ে করা যায়। একজন শিল্পীর কাছ থেকে যখন কলম ছিনিয়ে নেয়া হয়, যখন তার হাত-পা বেঁধে দেয়ার চেষ্টা চলে, তুলিকে বাধ্য করা হয় তথাকথিত সিস্টেম অনুযায়ী চলতে, মেনে নিতে, ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করার ষড়যন্ত্র চলে; তখন ওই শিল্পী খুন হন। শিল্প আহত হয়। শিল্পীর স্বাধীনতায়, শিল্পমনায়, ভাবনায়, প্রগতিশীলতায় আঘাত করা মানে তাকে খুন করা। ঋত্বিক ঘটকের মতো ব্যক্তি যিনি সারা জীবন সাধারণ মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছেন, মঞ্চে-চলচ্চিত্রে-লেখায় এবং যখন দেখা যায়, তিনি দিনের পর দিন কাজ করতে পারেননি। তাকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। বলতে দেয়া হয়নি। বিভিন্ন উপায়ে আটকে রাখার চেষ্টা চলেছে। তখন একে খুন ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে! ইরানিয়ান নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা জাফর পানাহির প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে অনেকখানি দরকারী। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তাকে হুট করে দ- দেয়া হলো। জেল-জরিমানা নয়। শাস্তি ২০ বছর তিনি কোন সিনেমা বানাতে পারবেন না, লিখতে পারবেন না, কোথাও সাক্ষাতকার দিতে পারবেন না। অর্থাৎ তার প্রধান অস্ত্র কেড়ে নেয়া হলো। তাকে পঙ্গু করে দেয়া হলো। খুন করা হলো। এর আগে নিজের দেশেই তার সিনেমা নিষিদ্ধ হওয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে পানাহিকে। অপরাধ কি? তিনি ইরানের প্রকৃত রূপ তুলে এনেছিলেন তার ছবিতে। তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, শিশুদের প্রতি, নারীদের প্রতি; তার সত্যবাদিতা, স্পষ্টবাদিতা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে শাসনযন্ত্রকে। ভুলে ভরা, বিশৃঙ্খলায় ভরা সিস্টেম, বিধান, শাসক সব সময় ভয় পায় সত্যের মুখোমুখি হতে। তাদের ঘুনে ধরা অস্তিত্বে নাড়া লাগে। সত্যের বাতাসে কেঁপে ওঠে তাদের মিথ্যার, অন্যায়ের মসনদ। ফলে শিল্পীর ওপর নেমে আসে দমননীতি। মুখে তালা এঁটে দেয়ার, শিল্পের উন্মুক্ত জানালা বন্ধ করে দেয়ার এই যে প্র্যাকটিস, এই যে অপচেষ্টাÑ সেটা সব সময়ই ছিল। এখনও চলছে অবারিত, নগ্নভাবে। সেই সক্রেটিস-যুগেও এর প্রমাণ মেলে। যদি এ সময়ে চোখ রাখা হয়, যখন তথ্যের অবাধ প্রবাহের কথা বলা হচ্ছে। মতের স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে। জোর দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে ব্যক্তি চিন্তার প্রসঙ্গ। প্রগতিশীলতার জোয়ার বইছে। যুক্তি পেয়েছে তার শক্তিশালী অবস্থান- বলে মনে করা হচ্ছে। এ সময়ে এসেও কি চিন্তা, শিল্প চলতে পারছে স্বাধীনভাবে? শিল্পের এই স্বাধীনতার, স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হওয়ার পথে বড়সড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসেই যায়। প্রশ্ন ওঠে স্বাধীনভাবে শিল্পচর্চার ক্ষেত্র নিয়ে। আগামীতে শিল্প তার নিজস্ব গতিতে প্রবাহিত হবে, নাকি স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা সেটি নিয়ন্ত্রিত হবে- সে বিষয়েও কপালে যথেষ্ট সন্দেহের, চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সময় এগিয়েছে অনেক। জ্ঞান অসংখ্য ডালপালা মেলে উড়ে উড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে- এটি যেমন দেখা যায়; চোখে পড়ে এই ডানা কেটে ফেলার, রক্তাক্ত করার অসংখ্য অপচেষ্টার উদাহরণ। এ কথা একেবারেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রগতিশীলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, নৃশংসতা, শিল্পকে-শিল্পীকে কুক্ষিগত করে ফেলার মনোভাবও বেড়েছে অনেকগুণ। তাই যখন একজন অভিজিৎ রায় রক্তাক্ত হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণে, তখন আমাদের বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে শূন্যে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোন পথ থাকে না। উদাহরণ আরও অনেক আছে। প্রত্যেক লেখক-শিল্পীই একেকজন উদাহরণ। প্রত্যেকেই আহত। রক্তাক্ত। শিল্পীমনে, লেখক মনে স্বাধীন উচ্চারণ করতে না পারার যন্ত্রণা। যে কথা বলা হচ্ছিল, সময়ের কথা, প্রগতিশীলতার হাত ধরে সময়ের এগুনোর কথা। এ সময়ে এসেও কেন এই আক্রমণ? শিল্পের মুখ চেপে ধরার এই অপচেষ্টার উৎসই বা কি? মৌলবাদিতা? সেটি একটি বড় কারণ। এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, অথবা আরও বিশেষভাবে যদি বাংলাদেশের কথাই বলা হয়, তবে দেখা যাবে, যখন থেকে জঙ্গীবাদ পাখা মেলার সুযোগ পেয়েছে অথবা সুযোগ দেওয়া হয়েছে; তখন থেকেই একের পর এক এ রকম ঘটনা ঘটেছে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়েছে। তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে একাধিকবার। তসলিমা নাসরিনকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তার হৃদয়ে এখনও নির্বাসিত হওয়ার যন্ত্রণা। মুক্তবুদ্ধির চর্চায় যারা আছেন, ছিলেন; ঘোষণা দিয়ে জঙ্গী অপশক্তি তাদের ঘাড়ে বসিয়েছে ধারালো কোপ। উদ্দেশ্য একটাই- নীরবতা প্রতিষ্ঠা। ‘তোমাকে চাই’ দিয়ে বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন আরও বহু বছরের বাংলা গানের গতিপথ, সেই কবির সুমনকেও কম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়নি! শাসকশ্রেণীর দ্বারা অপদস্থ হয়েছেন। মৌলবাদীদের দ্বারা। তার ‘অপরাধ’ ছিল তিনি শিল্পের সাধক। প্রচলিত নিয়মকে মেনে নেননি। সমালোচনা করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন, গানে-বক্তব্যে। শিল্পের সম্প্রসারণ, শিল্পীমনের বিকাশ মানেই অন্ধত্বের-গোঁড়ামির পরাজয়। শিল্প তো মেনে নেয়া শেখায় না। নত স্বীকার করে না। যারা শিল্পের সাধক, হোক কলমে-তুলিতে-বাদ্যযন্ত্রে, প্রত্যেকেই দৃশ্যের ভেতরটা তুলে আনার চেষ্টা করেন, করেছেন যুগে যুগে। ঠিক এখানেই চরম আপত্তির রামদা তুলে সটান দাঁড়িয়ে থাকে কখনও শাসকশ্রেণী আর বেশিরভাগ সময়ই গোঁড়া-ধর্মান্ধ-মৌলবাদী গোষ্ঠী। তারা নিজেদের প্রাচীন ধ্যান-ধারণাই চাপিয়ে দিতে চায়। রক্তচক্ষু দেখায়। ভয়-ভীতি। বলতে হয় মাকসুদের কথা। আজ থেকে অনেক বছর আগে, সেই নব্বই দশকে, তিনি গানে গানে তুলেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। ধর্মীয় মৌলবাদ গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচনের চেষ্টা করেছিলেন, যা বাংলা ব্যান্ড সংগীতে ছিল সর্বপ্রথম। বিপদ হতে পারে জেনেও সোচ্চার হয়েছিলেন প্রতিবাদে। বিপদ এসেছিলও। অব্যাহত হুমকির মুখে ছিলেন। একটা মহল থেকে মৃত্যুপরোয়ানাও এসেছিল? ওই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে কনসার্ট করতে দেয়নি শিবির। এমনকি কাফনের কাপড়ও পাঠানো হয়েছিল তাকে! ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের গোলচত্বরে নির্মীয়মাণ লালন শাহর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার ঘটনা এখনও ভোলেনি কেউ। মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে একদল মাদরাসার ছাত্র তা-ব চালায় ভাস্কর্যের ওপর। ঠিক এর দেড় মাস পর ২৯ নবেম্বর তারা ভাঙ্গে মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য। দেশের সমস্ত ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় হামলা করে একদল ধর্মান্ধ। নির্যাতিত হন বাউল শিল্পীরা। গত বছর ঘটে যাওয়া বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানের খুনের ঘটনা এখনও ভোলেনি কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, অমর একুশে বইমেলা চলাকালীন ২৬ ফেব্রুয়ারি কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও কুপিয়ে জখম করে শত শত মানুষের সামনেই বীরদর্পে পালিয়ে যায় খুনিরা। এর পরের মাসেই, ৩০ মার্চ, ‘ধর্মের অবমাননার অভিযোগ’-এ রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুর রহমানকে। তা-ও দিনের আলোয়! সকাল সাড়ে নয়টার দিকে! ব্লগ ও অনলাইনে লেখালেখি করতেন তিনি। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন আহমেদ রাজীব হায়দার, রাজধানীর মিরপুরে। আসিফ মহিউদ্দীনকে খুন করা হয় একই বছরের ১৪ জানুয়ারি। দু’জনই লেখালেখি করতেন। চিত্রকলার দিকে তাকালে আমরা পাই মকবুল ফিদা হুসেনকে। স্বাধীনভাবে শিল্পচর্চার জন্য তাকে বাধ্য হয়ে বহু সমালোচনা-নিন্দার বোঝা মাথায় নিয়ে নিজের মাতৃভূমি ভারত ত্যাগ করতে হয়েছে। লাঞ্ছনা এসেছে। অপমানিত হয়েছেন। ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে যিনি সেরার আসনটি অলঙ্কৃৃত করে বসে আছেন, সেই রাজা রবি ভার্মার ওপরও আক্রমণ এসেছে। সমাজের সঙ্কীর্ণমনা গোষ্ঠী তার কাজে বাধা দিয়েছে বারবার। তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছে। তবে এই রাজা রবি ভার্মা, ঋত্বিক ঘটক, মকবুল ফিদা হুসেন, জাফর পানাহি, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, মাকসুদ, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর, রাজিব, আসিফ কিংবা ভেঙ্গেচুরে পড়ে থাকা লালনের ভাস্কর্যÑ যারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন, বাধা পেয়েছেন স্বাধীন শিল্পচর্চায়, মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন; কেউই নতি স্বীকার করেননি কখনই। বিশ্বসঙ্গীতের দিকে তাকালে অবাকই হতে হয়। নিষিদ্ধের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। বব ডিলান, বিটলস, এলভিস প্রিসলি, পিঙ্ক ফ্লয়েড নিষিদ্ধের কবলে পড়েছেন বারবার। এর মধ্যে বিবিসির নিষিদ্ধের তালিকায় পড়েছে বব ডিলানের ‘লেট মি ফলো ইউ ডাউন’। বিটলসের ‘কাম টুগেদার’, ‘আ ডে ইন লাইফ’, ‘লাকি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস’ তালিকা দীর্ঘ আরও। পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘ইট উড বি সো নাইস’, এলভিস প্রিসলির ‘হার্ড হেডেড উইমেন’Ñ নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে আরও অসংখ্য গান। তালিকায় রয়েছেন আরও অসংখ্য নামী শিল্পী। অভিযোগ কখনও রাজনৈতিক ইস্যু, কখনও যৌনতা, কখনও ‘ননসেন্স’ লিরিক ইত্যাদি ইত্যাদি। নিষিদ্ধ করাও আক্রমণের একটি ধরন। নিষিদ্ধ করা মানে চোখ রাঙানি দেয়া। কলমের ওপর, তুলির ওপর, বাদ্যযন্ত্রের ওপর সেন্সরশিপের নামে লাগাম সেঁটে দেয়া। বিধান লেপ্টে দেয়া যে, তুমি এটা করতে পারবে, ওটা করতে পারবে না। তোমার এটা নিয়ে বলা উচিত, ওটার কাছে ধারেও কখনও ঘেঁষবে না। এতে করে শিল্পের অবমাননা করা হয়। শিল্প কাঁদে। শিল্পী যখন তথাকথিত সিস্টেমের কাছে বন্দী হয়ে পড়ে, যখন শিল্পীকে বন্দিত্ব বরণ করতে হয়, শিল্প তখন শিল্প হয়ে ধরা দেয় না। হয়ে পড়ে কোণঠাসা। এই শৃঙ্খলাবদ্ধ শিল্প কিংবা শিল্পী কখনই একটি জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। যেমন মঙ্গলজনক নয় একজন শিল্পী, লেখকের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ঘটনাও। শিল্পচর্চা করতে গিয়ে শিল্পীকে যদি কারাবন্দী হতে হয়, যদি মামলার ঘানি টানতে হয়, নির্বাসিত হতে হয়, ভিটেমাটি ছাড়তে হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু শিল্প কিংবা শিল্পী কেন, পুরো জাতির ওপরেই পড়ে। জাতির জন্য, দেশের জন্য, শিল্পমনা মানুষের জন্য এটা কখনই ভাল ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। মঙ্গলজনক নয় এটি। যেমন মঙ্গল বয়ে আনে না বই নিষিদ্ধের ঘটনাও। পবিত্র বাইবেলও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল একসময়। ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত উইলিয়াম টেইন্ডাল অনূদিত বাইবেল নিষিদ্ধ করেন তৎকালীন রাজা অষ্টম হেনরি। অষ্টম হেনরি নিজের জীবনের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে বিস্তর ঝামেলায় পড়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন কোথাও যেন বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা না হয়। ফলে বাইবেলের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা তিনি নিতে পারেননি। পরিশেষে পুড়িয়ে ফেলা হয় অনূদিত বাইবেলের ছ’হাজার কপি। শুধু তাই নয়, প্রাণে বাঁচতে টেইন্ডালকে করতে হয়েছিল দেশত্যাগ। বর্তমানে সেই অনূদিত বাইবেলটিই পুরো বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মানুসারী মানুষ অনুসরণ করছে। গ্যালিলিও গ্যালিলির ‘বিশ্ববিধান সম্পর্কে কথোপকথনও’ নিষিদ্ধের তালিকায় পড়েছিল। চার্চের ধর্মগুরুদের ধারণা ছিল পৃথিবী স্থির এবং অন্যসব গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু গ্যালিলিও তাঁর ‘বিশ্ববিধান সম্পর্কে কথোপকথন’ গ্রন্থে বললেন : পৃথিবীসহ অন্যসব গ্রহ নক্ষত্র সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। চরম সত্য কথাটি চার্চের বিরুদ্ধে চলে যায়। পরবর্তীতে ক্ষুব্ধ পোপ অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্যালিলিওকে বন্দী করার নির্দেশ দেন। ১৬৪২ সালে গ্যালিলিওর বন্দী অবস্থায মৃত্যু হয়। তবে বন্দী দশা থেকে এক কপি চালান করে ছিলেন স্ট্রসবুর্গ-এ; যা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যালিলিওর সেই বিশ্ববিধান জোতির্বিদ্যার ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে। নিষিদ্ধকৃত আরেকটি ধর্মগ্রন্থ হলো ‘দ্য রামায়ানা এ্যাজ টোল্ড বাই অব্রে মেনেন’ আধুনিক আঙ্গিকে রামায়ণকে ব্যাখ্যা করায় গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয়। মার্ক টোয়েনের ‘দ্য এ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরিফিন’, জর্জ অরওয়েলের ‘এনিমেল ফার্ম’, হেনরি মিলারের ‘ট্রপিক অব ক্যান্সার’, মার্ক টোয়েনের আরেকটি বই ‘ইভস ডায়েরি’ও ছিল নিষিদ্ধের তালিকায়। ‘আনন্দময়ীর আগমনী’ কবিতা লেখার জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও কারাদ- ভোগ করতে হয়েছে। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত হয় কবিতাটি। নজরুল ইসলামকে আলিপুর জেলে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়। নিষিদ্ধ হয়েছিল মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি সমগ্র চট্টগ্রামে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। লালদীঘি ময়দানে বিকাল ৩টায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভার জনসমুদ্রে ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে বিক্ষুব্ধ জনতা সেøাগান দেয়। এর কয়েকদিন পর তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার কবিতাটি বাজেয়াফত করে। এই বাজেয়াফত কিংবা নিষিদ্ধ করার আরেক দৃষ্টান্ত রয়েছে গত অমর একুশে বইমেলায়। ব-দ্বীপ প্রকাশনী মেলায় এনেছিল একটি অনুবাদ সংকলন। বইটি সম্পাদনা করেছিলেন শামসুজ্জোহা মানিক। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অজুহাতে প্রকাশনীর স্টলটিই বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। শিল্পকে তার স্বাধীন স্রোতে চলতে দেয়াই, শিল্পীকে-লেখককে তার স্বাধীন ভাবনাটি ভাবতে দেয়া উচিত। অন্যথায় জাতি পিছিয়ে পড়তে পড়তে এক সময় রাষ্ট্র পঙ্গু হয়ে পড়বে। মানুষের চিন্তার খোরাক যোগায় যে শিল্প, যে শিল্পী, যে লেখক, যে গায়ক তারা স্বাধীনভাবে ভাবতে না পারলে, কাজ করতে না পারলে, শিল্পচর্চা তার নিজস্ব গতিতে না এগুতে পারলে, পুরো জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। যেটা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
×