ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিতাসের গাফিলতিই মূল কারণ

বনানীতে গ্যাসলাইন বোমায় রূপ নিল- বিধ্বস্ত ভবন

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৯ মার্চ ২০১৬

বনানীতে গ্যাসলাইন বোমায় রূপ নিল- বিধ্বস্ত ভবন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গাফিলতিতেই ঘটেছে বনানীর অগ্নিকা-। শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়িটিকে সাময়িকভাবে বসবাসের অনুপোযোগী ঘোষণা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তদন্ত কমিটি গঠন এবং কলসেন্টারের ফোন গ্রহীতা কর্মীর ওপর দায় চাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সিটি কর্পোরেশন আর ওয়াসাই এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে দুইটার দিকে রাজধানীর বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ির ছয়তলা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ছয়তলা ভবনে আগুন লেগে তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে। এতে অন্তত সাতজন আহত হন। ঢাকা উত্তরের নগরপিতা আনিসুল হক অভিযোগ করেছেন, তিন দিন আগে গ্যাস লিকেজের কথা তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ঘটনা ঘটার তিন ঘণ্টা আগে তিতাসের কলসেন্টারে ফোন করে সাহায্য চাইলেও কেউ আসেননি। রাজউক চেয়ারম্যান জিএম জয়নাল আবেদীন শুক্রবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বাড়িটি পরিদর্শন করে সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছি। বাড়িটিতে এখন বিদ্যুতলাইন নেই। এছাড়া বিভিন্ন তলায় বিস্ফোরণের চিহ্ন রয়েছে। বাড়ির মালিক নিজ খরচে সমস্ত লাইন নির্মাণ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে বসবাসের উপযোগিতার সনদ দিতে পারলে আমরা এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাব। সম্প্রতি উত্তরায় গ্যাস দুর্ঘটনায় বাবা-মা আর দুই সন্তান নিহত হওয়ার পর তিতাস বাড়ির মালিক আর হতভাগ্য পরিবারটির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ওই বাড়িতে তিতাসের কর্মীরা রাইজার সংযোজনের পরই গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেতÑ দগ্ধ সুমাইয়া মৃত্যুর আগে এমন তথ্য জানিয়ে গেলেও তিতাসের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায়নি। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে দুইটার দিকে আগুন লাগার পর তৃতীয় তলা থেকে উপরের সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আতঙ্কে ছাদে উঠে যান এবং সেখানে আটকা পড়েন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের নামিয়ে আনেন। এ ঘটনায় সাতজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বাড়িওয়ালার ছেলে নাভেদ ইমতিয়াজ দগ্ধ হয়েছেন, বাকিরা তাড়াহুড়ায় নামতে গিয়ে আহত হন। বিস্ফোরণে ভবনের দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার সামনের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। ফাটল দেখা দিয়েছে ‘ফলস পিলারে’। দুপুরে প্রতিটি ফ্ল্যাটের একজন করে বাসায় ঢুকতে দেয়া হয় মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা। আর বিকেলে তিতাসের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। শুক্রবার বিকেলে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলকে ডেকে সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি প্রিন্ট মিডিয়ার কাছ থেকে আড়াল করে তিতাস। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিতাস গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের ওপর দায় চাপায়। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ দাবি করে, সিটি কর্পোরেশন এবং ওয়াসার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে গ্যাসলাইন ছিদ্র হয়েছে। এখানে তাদের কোন দায় নেই। অন্যদিকে রাতে পত্রিকা অফিসগুলোতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার কথা জানায়। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তা পাঠায়নি তিতাস। জানা যায়, তিতাসের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন না দেয়ায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠাতে দেরি হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে তিতাসের জিএম ফকরুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যর একটি কমিটি গঠন করেছে তিতাস। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সিটি মেয়র আনিসুল হক জানান, বিস্ফোরণের দায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। তিতাস গ্যাসের পরিচালকের (অপারেশন) সঙ্গে বৈঠকে জানানো হয়েছে, সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদার গ্যাস লিক হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে তিন দিন আগে লিখিত অভিযোগ তিতাস গ্যাসকে জানিয়েছিলেন। তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি দাবি করেন, ভবনের উপর থেকে আগুন লেগেছে, রাস্তায় আগুন লাগেনি। তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) আলি আশরাফ বিকেলে ঘটনাস্থল থেকে জনকণ্ঠের কাছে কলসেন্টারে গ্যাসলাইন লিকেজের কথা জানানোর বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন আমরা এখন তদন্ত করছি। আমাদের তদন্ত দল এ বিষয়ে মতামত দেবে। কলসেন্টারের যে কর্মী অভিযোগ পাওয়ার পরও কোন ব্যবস্থা নেননি তার নাম জানতে চাইলে তিনি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এদিকে, ভবনের মালিক শামসুল আলমের সহকারী কামরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটা থেকে কয়েক দফায় তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। অভিযোগ কেন্দ্র থেকে ভবনের মালিকপক্ষকেই শ্রমিক যোগাড় করার পরামর্শ দেয়া হয়। তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্র থেকে জানতে চাওয়া হয়, যেখানে লিক হয়েছে সেখানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে কি-না। অভিযোগকারী বলেন, দেয়া হলেও তাতে কোন কাজ হয়নি। তখন তিতাসের ওই কর্মী বলেন, শ্রমিক যোগাড় করতে পারলে তারা যাবেন, নইলে তারা যেতে পারবেন না। তিতাসের কাছে অভিযোগ জানানোর প্রায় তিন ঘণ্টা পর ওই গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে অভিযোগকারীর বাসায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাড়ির মালিক ও আশপাশের বাসিন্দারা এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছেন, অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত। ভবনের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, আগুন লাগার দেড় ঘণ্টা পর তিতাসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আর শুক্রবার সকালে ছিদ্রটি মেরামত করে তিতাসের কর্মীরা। ভবনের মালিক ক্ষতিপূরণের জন্য তিতাসের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানালেও রাত পর্যন্ত বনানী থানায় কোন মামলা দায়ের হয়নি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
×