ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

অন্তরালের তারকা মনোয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৬ মার্চ ২০১৬

অন্তরালের তারকা মনোয়ার

উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলায় এক কিশোর স্বপ্ন দেখেছিল বড় ফুটবলার হওয়ার। তাই তো ছোটবেলায় বাবা-মায়ের আদর বাদ দিয়ে ছুটে এসেছিল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাভারের বিকেএসপিতে। ক্লাস সেভেনে মেধা তালিকায় ভর্তির সুযোগ হয়ে যায় স্বপ্নে ফুটবলের বীজবোনা সেই কিশোরের। এ্যাথলেটিক, হকি, ক্রিকেট এবং ফুটবল এই চার বিভাগেই সুযোগ হয়। ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ খুব একটা ছিল না। দৌড়ে বল ধরে আবার থ্রো করা, রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা কখনই তাকে আকর্ষণ করত না। তার নেশা ধ্যান-জ্ঞান যেন ফুটবলকে ঘিরেই। তাই সব বাদ দিয়ে ফুটবলেই নাম লিখিয়ে ফেলে এই কিশোর। সবচেয়ে কম বয়সেই ফুটবল মেধা দিয়ে বাংলাদেশ ফুটবলের জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়। তিনি হচ্ছেন অন্তরালের মিডফিল্ডার মনোয়ার হোসেন। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ। স্কুল ফুটবল কিংবা পাড়া-মহল্লায় মনোয়ার খুব নাম ডাক ছিল। সে থেকেই বড় ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে ব্রাদার্স-বিকেএসপি প্রদর্শনী ম্যাচে মনোয়ার অংশগ্রহণ করেন। চমৎকার খেলে সবার দৃষ্টি কাড়েন। তৎকালীন ব্রাদার্সের কোচ মোঃ সেলিম তাকে ক্লাবে খেলার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু মনোয়ার তখন রাজি হননি। ওই বছরেই বাংলাদেশ জাতীয় দল বিকেএসপির সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। তারকা সমৃদ্ধ জাতীয় দল ১-১ গোলে ড্র করে। বিকেএসপির পক্ষে গোলটি করেন মনোয়ার। চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তখনই জাতীয় দলের কোচের নজরে পড়ে যান কিশোর ফুটবলারটি। ১৯৯৫ সালে ফকিরেরপুল ইয়েংমেন্স ক্লাবে যোগ দিয়ে ফুটবলের বড় আসরে খেলার সূচনা করেন মনোয়ার। সেখানে তিন বছর খেলার পরেই আমন্ত্রণ পেয়ে জান জাতীয় দলে খেলার । ১৯৯৮ সালে জাতীয় দলে সুযোগ হওয়া মনোয়ার বাংলাদেশ ফুটবলের অনেক স্মরণীয় ম্যাচের সাক্ষী। জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৯৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৯ সালে নেপালে সাফ গেমস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের গর্বিত সদস্য ছিলেন । ১৯৯৯ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় ফুটবল দলের, ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দলে এবং ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব ২৩ জাতীয় ফুটবল দলের নেতৃত্ব দেন এই সুদর্শন ফুটবলার মনোয়ার। জাতীয় দলের হয়ে ২০০২ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত জিগমি দর্জি অয়াংচাক মেমোরিয়াল গোল্ডকাপ জয় করেন। তাছাড়া ২০০৩ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ গেমস চ্যাম্পিয়নশিপেও চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। অন্যান্য খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা জুনিয়র দলে খেলে জাতীয় দলে সুযোগ পান। মজার বিষয় হচ্ছে, মনোয়ার জাতীয় দলে খেলে পরে অনূর্ধ্ব ১৬ দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফকিরেরপুল ইয়েংমেন্স ক্লাবে তিন বছর খেলা শেষে যোগ দেন বাড্ডা জাগরণীতে । ২০০০ সালে যোগ দেন তার প্রিয় দল ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। সেখানে খেলেন ২০০৩ পর্যন্ত। এরপর ব্রাদার্স মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ রাসেল । পরবর্তীতে ২০১১ সালে মোহামেডানে ফিরে আসলে আর নিয়মিত খেলা হয়নি। ক্লাব ফুটবলে স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে মনোয়ার বলেন, ২০০২ সালে মোহামেডানের হয়ে মোহামেডান-আবাহনী ফাইনাল ম্যাচ। টান টান উত্তেজনার ফাইনাল ম্যাচে নির্ধারিত সময়ে দু’দল গোল শূন্যভাবে খেলা শেষ হলে ফাইনাল গড়ায় টাইব্রেকারে। শেষ শটে গোল হলেই মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন। দায়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। পুরো খেলায় ভাল খেলে আমার মনোবল তখন তুঙ্গে। গ্যালারি ভর্তি সমর্থক। সবায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বৃষ্টি ভেজা মাঠ। আমি শট নিতে গিয়েই পিছলে পড়ে ওই অবস্থাতেই শট নিলাম। ফলে যা হবার তাই হলো। গোল হলো না । মোহামেডান গ্যালারি স্তব্ধ। আমি হতবাক। আমার তখন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সাডেন ডেথে খেলা গড়াল। আবাহনীর আরমান ভাই মিস করলে মোহামেডানের বদলি খেলোয়াড় তুষার গোল করে মোহামেডানকে শিরোপা এনে দেয়। সেই মুহূর্তের অবস্থার কথা আমি কোনদিন ভুলব না। দলের প্রয়োজনে অনেক গোল করেছেন এবং করিয়েছেন এই সুদর্শন ফুটবলার। তবে যেবার শেষ ম্যাচে মনোয়ারের করা গোলে ব্রাদার্স ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়ন হয় সেই স্মৃতি হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে বলে তিনি জানান। দেশের ফুটবলে নিজের পছন্দের ফুটবলার প্রসঙ্গে মনোয়ার বলেন, মিডফিল্ডার আরমান মিয়া আর সেরা মানুষ হাসান আল মামুন। কোন খেলোয়াড়কে সমীহ করতেন? তিনি জানান নিঃসন্দেহে ডিফেন্ডার জুয়েল রানা। জুয়েল রানা কে বিট করা খুব কঠিন কাজ ছিল। বাংলাদেশ ফুটবলের উন্নতির জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিতÑএই প্রশ্নে মনোয়ার বলেন, স্কুল ফুটবলের উপর জোর দিতে হবে। তাছাড়া বয়সভিত্তিক দল থাকা অত্যন্ত জরুরী। জাতীয় দলের কয়েকটা ক্যাটাগরি যেমন এ বি সি রাখতে হবে। একজন খেলোয়াড় যখন জাতীয় দল থেকে বাদ যাবে তখন যেন সে বি অথবা সি দলে খেলার সুযোগ পায়। জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত প্রসঙ্গে মনোয়ার বলেন, বিদেশের মাটিতে খেলা শুরু হওয়ার পূর্বে মাঠে বিউগলে জাতীয় সঙ্গীতের সুর বাজানো হয় ঠিক সেই মুহূর্তটি শুধু আমার নয় আমাদের সব খেলোয়াড়দের সব চাইতে স্মরণীয়। আজও সে মুহূর্তের কথা মনে হলে আগের মতোই অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসের স্মৃতি আজও অম্লান। সেবার মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলাম আমি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখনও খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন? এত তাড়াতাড়ি খেলা থেকে সরে এলেন কেন? মনোয়ারের জবাব, ফুটবলের হতাশা আর কিছু কষ্টের কারণেই ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছি। সম্প্রতি জাতীয় দলের ছয়জন খেলোয়াড়কে শাস্তি দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে এটা সব দেশেই আছে। দেশ এবং ক্লাবের প্রতি খেলয়াড়দের কমিটমেন্ট থাকা উচিত। ঠিক তেমনি ম্যানেজমেন্টেরও তাদের দিকটা দেখা দরকার। লিগের মাঝপথে দলবদল বিষয়টা কিভাবে দেখেন? মনোয়ার বলেন, অবশ্যই ভালভাবে দেখি না। এখন ফুটবলে ভাল টাকা আছে । ক্লাব থেকে আমি অর্থ নিব আর মাঠে তাইরে নাইরে করে লিগ শেষ করব সেটা হতে পারে না । তাছাড়া মাঝ পথে যদি কেউ অন্য ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তখন সে ভাল খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ক্লাবগুলো এত অর্থ ব্যয় করে খেলোয়াড় সংগ্রহ করে, এ বিষয়গুলো অবশ্যই মেনে নেবে না। পাঁচ ভাই দুবোনের মাঝে মনোয়ার ৫ম। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত। বিদেশ বিভুঁইয়ে মনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কল্যাণে মাস্টার্স করেন। দীর্ঘ পরিণয়ের পর ২০০৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী জুয়েনা জুসি একজন নৃত্যশিল্পী। একটি ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী এবং দুই কন্যাসন্তান জুনাইরা তেহজিব ও সুনেহরা তানাজ নিয়ে সুখের সংসার। ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলেও ফুটবলকে ঘিরে এখন স্বপ্ন দেখেন। ইতোমধ্যে কোচিংয়ে এএফসি সার্টিফিকেট কোর্স ( সি ) সম্পন্ন করেছেন। ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে সুযোগ পেলে দেশের হয়ে কাজ করার। বিদেশের মাটিতে বিউগলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠার সময় দুচোখ বেয়ে যে অশ্রু ঝরেছে, খেলোয়াড় হিসেবে তা হয়ত আর কখনই হবে না মনোয়ারের। কিন্তু তার বিশ্বাস দেশের ফুটবলের সুদিন একদিন আসবে। আবার মাঠমুখী হবে দর্শক। একজন দর্শক কিংবা দলের সদস্য হিসেবে বিউগলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠার সময় দুচোখ বেয়ে আবারও অশ্রু ঝরাতে চান এক সময়ের মাঠ কাঁপানো মিডফিল্ডার মনোয়ার।
×