ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

“হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন”

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ৯ মার্চ ২০১৬

“হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন”

মঙ্গলবার ৮ মার্চ। কুয়াশামোড়া লন্ডনে খুব সকালে তখনো আমার ঘুম ভাঙেনি। টেলিফোনটা ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল। ভিয়েনা থেকে অনুজপ্রতীম লেখক ও সাংবাদিক নজরুল ইসলাম টেলিফোন করেছেন। বললেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদা মীর কাশেমের মৃত্যুদ-াদেশ সুপ্রীমকোর্ট বহাল রেখেছে। জামায়াত অবশ্য তার প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। কিন্তু দেশে আনন্দ-উল্লাস চলছে।’ খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেন জানি না নজরুলের একটি কবিতার লাইন সহসা মনে জেগে উঠল। ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন।’ নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন অন্য এক প্রেক্ষিতে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষিতেই কবিতার লাইনটি আমার কাছে যেন অর্থবহ হয়ে উঠল। এই মৃত্যুদ-টি দেশে মানবতা ও মানবিকতার শক্তির কথাই ঘোষণা করেছে। আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। কিন্তু সকল মৃত্যুদ-ের নয়। রাগের মাথায়, স্বার্থ বা সম্পত্তির কারণে কেউ যদি কাউকে হঠাৎ খুন করে ফেলে সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দানের বদলে অন্য কোন চরম শাস্তি তাকে দেয়া হলে আপত্তি নেই। কিন্তু একজন সিরিয়াল কিলার, জন্ম থেকে যার মানসিকতা অসুস্থ এবং কোন চিকিৎসাতেই যাকে সুস্থ করা যাবে না, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া সমাজ ও মানবতার স্বার্থেই আবশ্যক। বিলাতে এক সিরিয়াল কিলারের কথা কাগজে পড়েছি। সে গভীর রাতে পথচারী তরুণীকে নির্জন রাস্তায় আক্রমণ করত এবং শুধু ধর্ষণ করা নয়, ধর্ষণের পর নির্মমভাবে তরুণীকে হত্যার চেষ্টা করত। সে জন্ম থেকে গুরুতর মানসিক রোগগ্রস্ত বলে ডাক্তাররা রায় দিয়েছিল। সদাশয় বিচারকরা তাকে কয়েকবারই যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়ে (ব্রিটেনে মৃত্যুদ- নেই) জেলের সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে এবং সেখানে চিকিৎসার পর তার মধ্যে সুস্থতার লক্ষণ দেখা গেলেই তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এই ব্যক্তি জেল থেকে বেরিয়ে কিছুদিন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছে। কিন্তু তারপরই আবার আগের চরিত্রে ফিরে গেছে। প্রতিবার সুস্থ হওয়ার ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে সে জেল থেকে বের হয়েছে এবং একজন করে তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করেছে। শেষবারের বিচারে আদালত তাকে যাবজ্জীবন (মৃত্যু পর্যন্ত) কারাদ- দিলে সে আদালতের কাছে আর্জি জানায়, তাকে যেন বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে অবিলম্বে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। কারণ, সে বুঝতে পেয়েছে, তার রোগটি সেরে যাবার নয়। সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটানোর চিকিৎসাহীন গুরুতর রোগে আক্রান্ত। তাকে মৃত্যুদ- দিয়ে সমাজকে বিপদমুক্ত করা হোক। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতী নেতাদের এই সিরিয়াল কিলারের চাইতেও বড় অপরাধী এবং মানবতার জঘন্য শত্রু বলে বিবেচনা করি। এরা একজন-দু’জন মানুষ খুনের জন্য দায়ী নয়। এরা হাজার হাজার নর-নারী ও শিশু হত্যার জন্য দায়ী। বর্ণিত ব্রিটিশ সিরিয়াল কিলারের মতো শত চিকিৎসাতেও এদের ঘাতক চরিত্র পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই। ১৯৭১ সালে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ তথা গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করার পর দীর্ঘ ৪৫ বছরেও তারা অনুতপ্ত হয়নি। বিবেক পীড়া বোধ করেনি। জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। বরং সুযোগ পাওয়ামাত্র রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের কা-ে আবার লিপ্ত হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আইআরএ দল এখন অস্ত্র ও সন্ত্রাস ত্যাগ করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে এসেছে। নেপালের প্রচ- শক্তিশালী মাওবাদীরা পর্যন্ত সন্ত্রাসের রাজনীতি ছেড়ে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জামায়াতীরা গত পয়তাল্লিশ বছরেও অস্ত্রের রাজনীতি, সন্ত্রাসের রাজনীতি, দেশের স্বাধীনতা ও মানবতার বিরুদ্ধে অবিরাম ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ত্যাগ করেনি। বরং দেশের অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসাকে সন্ত্রাসী তৈরির আখড়ায় পরিণত করেছে। গত সাধারণ নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে জামায়াত এবং জামায়াতের ঔরস থেকে সৃষ্ট সন্ত্রাসী দলগুলো দেশে বোমাবাজি ও পেট্রোলবোমা হামলায় নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারার যে বীভৎস আন্দোলন শুরু করেছিল, তাতে অন্য কোন দেশ হলে এই দুটি দলকেই সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ দল ঘোষণা করা হতো। পয়তাল্লিশ বছরেও জামায়াত নেতারা তাদের ঘাতক চরিত্র পরিবর্তন করেনি, হত্যা ও সন্ত্রাস থেকে নিবৃত্ত হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য একবারও অনুতাপ প্রকাশ করেনি, জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। বরং তাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য গর্ব প্রকাশ করেছে। তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ ঢাকা দেয়ার জন্য বিশ্বময় মিথ্যা প্রচার চালিয়েছে এই বলে যে, গোলাম আযম থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পর্যন্ত সকল যুদ্ধাপরাধীই হচ্ছে আসলে ইসলামিক স্কলার। এদের মৃত্যুদ- দিয়ে হাসিনা সরকার বাংলাদেশ থেকে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন নির্মূল করতে চায়। এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে একাত্তরের বর্বর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দান বানচাল করার জন্য এরা মধ্যপ্রাচ্যের শেখ ও বাদশাহদের অর্থানুকূল্যে পশ্চিমা বিশ্বে মিডিয়া এবং বিখ্যাত আইনজীবী পর্যন্ত ভাড়া করেছে এবং দেশের বুদ্ধিজীবীদের একাশংকেও ভাড়া করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছে। অর্থ ও প্রচারশিক্তর জোরে তারা কয়েকটি পশ্চিমা দেশ এমনকি জাতিসংঘকেও পর্যন্ত প্রভাবিত করে। এর ফলে পশ্চিমা অনেকগুলো দেশ এই যুদ্ধাপরাধীদের চরম দ- না দেয়ার জন্য হাসিনা সরকারের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যখন সামরিক জান্তা জুডিশিয়াল মার্ডারের ব্যবস্থা করে, তখন তার প্রাণ রক্ষার জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো যে চাপ দেয়নি, সাদ্দাম হোসেন ও গাদ্দাফির হত্যকা-ে যে পশ্চিমা শক্তি টুশব্দ করেনি, বরং উৎসাহ দেখিয়েছে; বাংলাদেশের মানবতার শত্রু নারীঘাতী, শিশুঘাতী বর্বরদের প্রাণরক্ষার জন্য সেই পশ্চিমা শক্তি, এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবকে পর্যন্ত দেখা গেল খুবই উচাটন। দেশের বাইরের এই প্রচণ্ড চাপ, দেশের ভেতরে শক্তিশালী বিরোধিতা এবং নিজের জীবনের ওপর বড় ধরনের হুমকি- সবকিছু অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা স্বাধীনতার শত্রু এবং মানবতার বিরুদ্ধে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও দ-দানের ক্ষেত্রে যে সাহস ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিলেন, সেজন্য তিনি ইতিহাসে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। জাতিকে তিনি কলঙ্কমুক্ত করেছেন; এর চাইতে বড় কৃতিত্ব একজন রাজনৈতিক নেত্রীর আর কী হতে পারে? ভবিষ্যতের ইতিহাসে হাসিনা সরকারের অনেক ভালমন্দ, ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার সমালোচনা থাকতে পারে; কিন্তু ব্যক্তি হাসিনা ও নেত্রী হাসিনা ইতিহাসে নিজের জন্য যে স্থানটি করে নিলেন, তা থেকে কেউ তাকে কোনদিন সরাতে পারবে না। মীর কাশেমের মৃত্যুদ- বহাল থাকায় আমি দুঃখিত নই এ কথাটা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। তিনি আমার শত্রু নন, তাকে আমি কোনদিন দেখিওনি। কিন্তু তিনি জাতির শত্রু এবং মানবতার শত্রু। এই ধরনের একজন শত্রুকে অনুকম্পা দেখালে আমার লেখায় বর্ণিত ব্রিটিশ সিরিয়াল কিলারের মতো তার মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি ও মানবতাবোধ ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই ববং মীর কাশেম তার সাম্প্রতিক কার্যকলাপ দ্বারাও প্রমাণ করেছেন, তিনি তার অতীতের কার্যকলাপের জন্য অনুতপ্ত তো হনইনি, বরং দেশের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে আরও জঘন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের জামায়াতী চক্রের আসল জগৎশেঠ। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি বা দুর্বলতার সুযোগে মীর কাশেম যে তার প্রাপ্য চরম দ- থেকে অব্যাহতি পায়নি এজন্য আপীল আদালতের বিচারপতিদের প্রজ্ঞা ও বিবেচনাকেও ধন্যবাদ জানাই। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দান দ্বারা জাতিকে কলঙ্কমুক্ত এবং মানবতাকে বিপদমুক্ত করার কাজে দেশের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, গণজাগরণ মঞ্চ এবং আরও কয়েকটি ছোট-বড় সংস্থা যে অবিরাম চাপ সৃষ্টি করে আসছিল এবং এখনও রেখেছে সেজন্যে তাদের অভিনন্দন জানাই। এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা বলি। মঙ্গলবার ভিয়েনা থেকে নজরুল ইসলামের টেলিফোন পাওয়ার পরই লন্ডন থেকে আমার বয়সী এক বন্ধুর টেলিফোন পেলাম। তিনি এক সময় ভাসানী ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের সমর্থক হয়েছিলেন। এখন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমালোচক। এই বন্ধু কয়েকদিন যাবৎই ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম সংক্রান্ত বিতর্কে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আমাকে সকাল-সন্ধ্যা টেলিফোন করছিলেন। মঙ্গলবার টেলিফোনে মীর কাশেমের দ- বহাল থাকায় স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করলেন। আমি সুযোগ পেয়ে তাকে বললাম, আপনি প্রথম আলোর মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনামের সমর্থক। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমায় কেবল একটি বলার কথা। মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম এককালে বামপন্থী রাজনীতি করা সত্ত্বেও হালে চরম দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাবার অবিরাম চেষ্টা করেছেন। তাদের চেষ্টা সফল হলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- হতো বলে কি আপনি মনে করেন? বালাদেশের পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হওয়া কি ঠেকানো যেত? বন্ধু নিরুত্তর। তাকে বলেছি, বাংলাদেশে মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামদের চেষ্টা যদি সফল হতো, ড. কামাল হোসেন বা ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিরা যদি ক্ষমতায় আসতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং একাত্তরের মানবতার শত্রু এই জঘন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দানের মতো সাহস, শক্তি এবং দেশপ্রেম তারা দেখাতে পারতেন বলে আপনি কি মনে করেন? শেখ হাসিনা তাদের মতো প-িত হতে না পারেন, কিন্তু যে সাহস ও দেশপ্রেমের তিনি অধিকারী, তা এদের মধ্যে নেই। এজন্যই দেশের তাবৎ শীর্ষ প-িত নেতাদের রাজনীতিতে মাইনাস করে দিয়ে শেখ হাসিনা এখনও ক্ষমতায় টিকে আছেন। তার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তার নেতৃত্বের মধ্যে গণতান্ত্রিক শক্তির উদ্বোধন ঘটেছে। [ল-ন, ৮ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৬]
×