ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী নারীকে ‘অবলা’ বলে অসম্মানের দিন ফুরিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৮ মার্চ ২০১৬

বাঙালী নারীকে ‘অবলা’ বলে অসম্মানের দিন ফুরিয়েছে

সমুদ্র হক ॥ নারীশিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় নারী আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা এখন নিজেদের আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল। একই সঙ্গে পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে নারী এখন লোকলজ্জা কাটিয়ে অশান্তির শিকার না হয়ে আগের মতো আপোস না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। পাশাপাশি অর্থনীতিতে নারীর অবদান দিনে দিনে বাড়ছে। নারী যে শুধু বাইরে কাজ করে তাও নয়। রান্নাবান্না শিশু পরিচর্যা ও ঘরদোর সামলানো সবই করছে তারা। শিক্ষাক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নারী শিক্ষার্থীর হার পুরুষের চেয়ে বেশি। উচ্চশিক্ষায় এখনও পুরুষের হারকে ডিঙ্গাতে পারেনি। তবে শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ার যে চিত্র মিলছে তাতে আগামীতে উচ্চ বিদ্যাপীঠে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে। বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) সূচকে নারী উন্নয়নে এগিয়েছে। গত বছর শুরু হওয়া সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) সূচক অতিক্রমেও এগিয়ে যাচ্ছে। নারী উন্নয়নের এ ধারা নিয়ে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব নারী দিবস। নারী তো বাইরে কাজ করছে, ঘরের ভেতরেও তারা এগিয়ে। ঘরে পুরুষের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি তারা গৃহস্থালির নানা কাজ করে। এই দেশে নিজের ঘরের কাজে নারীর কোন পারিশ্রমিক বা মজুরি নেই। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) সময় ব্যবহারের এক জরিপে দেখা যায়, একজন কর্মজীবী নারী ঘরে ফিরে কাজ করে দৈনিক গড়ে তিন ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। আর পুরুষ ঘরের কাজ করে মাত্র এক ঘণ্টা ২৪ মিনিট। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ আর্থিক মূল্যমান নির্ধারণ হয় না। এ অবদান আড়ালেই থাকে। অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি নারী কৃষি শিল্প সেবা খাতে কাজ করছে। এভাবে উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেশের বৃহত্তম চলন বিল শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের আধারের কৃষক ও জেলেরা যখন উদ্বাস্তু হয়েছে তখন জৈবসারে ভরা ভূমিতে নারী চাষাবাদের যাবতীয় কাজ (চারা তৈরি, রোপণ, পরিচর্যা, ফসল উৎপাদনের পর মাড়াই-কাটাই এবং বিপণন) করছে। একই সঙ্গে তারা সন্তান লালন ও ঘর-গৃহস্থালি সামলাচ্ছে। কৃষি অর্থনীতির খাতে অর্ধেকের বেশি এখন নারী। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ইকোনমিক্যালি এ্যাকটিভ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যে বলা হয়েছে, প্রাথমিকে যত শিক্ষার্থী পাঠ নিচ্ছে তার ৫৭ শতাংশই নারী। মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার্থী ৫৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থী ৪৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত কিছুটা সন্তোষজনক। চিকিৎসা শাস্ত্র ও আইন পেশা শিক্ষায় নারীর হার ৩৯ শতাংশ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে এ হার ৪১ শতাংশ। শিক্ষাজীবন শেষে চাকরিতে প্রবেশের সময় নারীর অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। দেশে সরকারী চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে প্রায় ১৪ লাখ ৮৭ হাজার। তবে এর মধ্যে কর্মরত চাকুরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। মোট চাকুরের ২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ নারী। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সূত্র আশার কথা শুনিয়েছে এই বলে, প্রতিবছর নারী চাকুরের সংখ্যা বাড়ছে। বিসিএস ক্যাডারেও নারীরা বেশি আসছে। পুলিশ, সেনা, বিমান, নৌবাহিনীতে আগে নারীর অংশগ্রহণ ছিল না। বর্তমানে নারী বিমান সেনাও (বৈমানিক) হয়েছে। সূত্র জানায়, বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষক হওয়ার সংখ্যা এখনও কম। যদিও পরিবারের বড় অংশ নারীকে শিক্ষকতা পেশায় দেখতে চায়। শিক্ষা বিভাগের একই সূত্র জানায়, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে বিসিএস ক্যাডারে শিক্ষকের এখনও ৩০ শতাংশ নারী। নারীর এ উন্নয়নের হার সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গত দশ বছরে। কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে পুরুষের কাছে যে কাজ কঠিন নারী সে কাজও করছে। বগুড়ার নদী ভাঙ্গন এলাকায় নারী মোটরগাড়ি চালানোর পাশাপাশি মোটর মেকানিকের কাজও করছে। নারীর এ এগিয়ে যাওয়ায় তারা এখন সকল ক্ষেত্রেই স্বাবলম্বী হতে শিখছে। তারা এখন দেখেশুনে যাচাই করে বিয়ের সঙ্গী বেছে নেয়। একটা সময় যেমন প্রণয়ের ফাঁদে পা দিয়ে বিয়ে করে পরবর্তী জীবনে অশান্তি পোহাতে হতো, বর্তমানে তা আর ঘটছে না। নির্যাতনের সামান্যতম রেশ দেখা দিলে বিয়ে বিচ্ছেদকেও বেছে নিচ্ছে। এ বিষয়ে এক সমাজবিজ্ঞানীর মন্তব্য- মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। যৌতুকের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হলে নারী এখন আইনের আশ্রয় নিচ্ছে। অনেক সময় দম্পতির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে সেখানেও বিচ্ছেদের নোটিস দেয়া হচ্ছে পৌরসভা অথবা সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে। তবে তিন মাসের মধ্যে এসব ভেঙ্গে যাওয়া বিয়ের কিছুটা জোড়াও লাগছে। “একটা সময় নারীকে অমর্যাদা করে বলা হতো অবলা নারী। একবিংশ শতকে মানুষ গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে গবেষণা করছে, সেখানেও নারীর অবদান কম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল এ্যারোনোকিস এ্যান্ড স্পেস্রাডমিনিস্ট্রেশনে (নাসা) নারী বিজ্ঞানী আছেন। সেখানে ‘অবলা’ বলে অমর্যাদার দিন ফুরিয়েছে। বাঙালী নারী হিমালয়ের চূড়াতেও উঠেছে। বাঙালী নারী মাথা উঁচিয়েই থাকবে”- পুরো এ মন্তব্য এক নারীর। বাঙালী নারীর এগিয়ে চলার পথেই পালিত হচ্ছে বিশ্ব নারী দিবস।
×