ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনই মূল কারণ

হঠাৎ করেই তৃণমূলে সাংগঠনিক সঙ্কটে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ মার্চ ২০১৬

হঠাৎ করেই তৃণমূলে সাংগঠনিক সঙ্কটে আওয়ামী লীগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ গোছানো মাঠে অগোছালো আওয়ামী লীগ! ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে দলটি। তৃণমূলে বিদ্রোহের আওয়াজ কানে আসছে দলটির হাইকমান্ডের। তৃণমূলে বিএনপি বা অন্য কেউ নয়, বেশিরভাগ স্থানেই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এখন আওয়ামী লীগই। বহিষ্কারের হুমকি, কেন্দ্র থেকে চাপ এবং পুরস্কৃত করার লোভ দিয়েও ‘বিদ্রোহী’ দমাতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। বরং ত্যাগী ও নিবেদিত নেতারা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটি। স্বতন্ত্রের নামে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি এবং নিজ দলের বিভক্ত নেতাকর্মীরা একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে স্থানীয় এই বড় নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কায় উদ্বিগ্নও দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আগামী ২২ ও ৩১ মার্চ অনুষ্ঠেয় এক হাজার ৩৯০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে পাঁচ শতাধিক ইউপিতেই এক থেকে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় বিপাকে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলটির। দুশ্চিন্তার বলিরেখাও ফুটে উঠেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের। এ অবস্থায় শুধু বহিষ্কার করেই এ কোন্দল মেটানো সম্ভব হবে না। বরং দল দুর্বল হবে। দলের প্রাণ তৃণমূলকে ঠিক রাখতে বিকল্প কৌশল খুঁজছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কোন্দল থামাতে গিয়ে ঢালাও দলের বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করলে তৃণমূলে সংগঠন করবে কারাÑ এ প্রশ্ন এখন দলের নেতাদের মুখে মুখে। দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার মতে, যারা ইউনিয়ন পরিষদে প্রার্থী হয়েছেন তাদের সবাই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বহিষ্কার করা হলে তখন পাড়া-মহল্লায় দ্বন্দ্ব শুরু হবে। যার প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে। সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে অসম্ভব হবে। তাই বাধ্য করে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে না দিয়ে বিদ্রোহীদের বিষয়ে আপাতত মধ্যপন্থা অবলম্বনের চিন্তাভাবনা করছে দলটি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল, বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবার। এখানে মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা থাকবেই। প্রতি ইউনিয়নে ৩ থেকে ৪ জন করে যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। তাদের একজন মনোনয়ন পেলে বাকিরা মনোক্ষুণœ হবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। তবে পৌর নির্বাচনে যেভাবে আমরা বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ ও দ্বন্দ্ব নিরসন করেছি, তা ইউপিতেও করতে পারব বলে আশা রাখি। কেননা আওয়ামী পরিবারের সবাই আদর্শিক রাজনীতি করে। দলের বৃহত্তর স্বার্থে বিদ্রোহী এই ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করবে বলেও আমি মনে করি। ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ের দফতর সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ মিলিয়ে এক হাজার ৩৯০টি ইউপির মধ্যে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাড়ে ৭শ’ বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গত বছর অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী ছিলেন প্রায় ৭০ জন। এদের মধ্যে ১৭ জন জয়ী হন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্র থেকে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকেই কেন্দ্র থেকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয়ভাবে না করার বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন। পৌর নির্বাচন দলীয়ভাবে হলেও ইউপি নির্বাচন নির্দলীয় অনুষ্ঠানের পক্ষেই ছিলেন তারা। বেশিরভাগ দলীয় সংসদ সদস্যরাও এ পক্ষেই ছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হলে তৃণমূলে ‘চেইন অব কমান্ড’ থাকবে না। যেহেতু তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঘিরে তাদের রাজনীতি, সেহেতু ইউপি নির্বাচন একজনকে মনোনয়ন দিলে অন্যজন নাখোশ হবেন। এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়বে। তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এমপিদের দূরত্ব বাড়বে। তাছাড়া নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাত ঠেকানোও কঠিন হবে। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে দলটির হাইকমান্ড দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন করার পক্ষে অনড় থাকায় এমপি ও তৃণমূল নেতাদের অনুরোধ ধোপে টেকেনি। প্রথম দুই ধাপের দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর এমপিরা যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, এখন তা-ই বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে। এমপিরা তৃণমূলের প্রার্থী বাছাইয়ের মনোনয়ন বোর্ডের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীরা পরোক্ষভাবে দুষছেন দলের সংসদ সদস্যকেই। তাদের বেশির ভাগেরই অভিযোগ, এমপি জোরালোভাবে সুপারিশ করলে সুযোগসন্ধানীরা এভাবে দলীয় মনোনয়ন পেত না। আবার অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীই দলীয় মনোনয়নে ‘বাণিজ্যলক্ষ্মীর’ অভিযোগও করছেন প্রায় প্রকাশ্যেই। প্রায় অর্ধশতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীদের অভিযোগ, তৃণমূলে গঠিত মনোনয়ন বোর্ড দলের জন্য ত্যাগ বা আদর্শ বিবেচনা করেনি, বিপুল অর্থের লেনদেনে অজনপ্রিয় ও সুযোগসন্ধানী উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা অনেক নেতাও মনোনয়ন পেয়েছেন শুধু অর্থের লেনদেনে। সদ্য ডিগবাজি দিয়ে দলে ভেড়া অনেক নেতার ভাগ্যেও মনোনয়ন শিকা ছিঁড়েছে। সারাদেশে খোঁজ নিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যের এমন অনেক নজিরই মিলেছে। প্রায় প্রকাশ্যেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেনÑ কীভাবে মনোনয়ন বাণিজ্য করে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে, তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ড বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কীভাবে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডকে বিভ্রান্ত করেছে। জানা গেছে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে থাকলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে এক থেকে দুই হাজার বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। সবাইকে বহিষ্কার করতে গেলে দল তৃণমূলে দুর্বল হয়ে পড়বে, বিভক্তিও বাড়বে। দলীয় সূত্র জানায়, দলীয় ও বিশেষ একটি সংস্থার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছে দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কেমন হতে পারে সেই সংখ্যা নিরূপণ করতে। ওই জরিপের ফলাফলে ভীষণ হতাশ করেছে ক্ষমতাসীনদের। তাই বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে বহিষ্কারের ভয়ভীতির বাইরে আর কী কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে, সেটি নিয়েও ভাবছে দলটি। ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেঁকে বসুক তা কিছুতেই চায় না শাসক দলটি। আবার বিদ্রোহীর সংখ্যাও অস্বাভাবিক হারে থাকবে সেটাও চায় না তারা। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সব ঠিক রাখার চিন্তা রয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। প্রার্থীদের কেন্দ্র থেকে বাধ্য করে বসানো, বহিষ্কারের ভয়ভীতি দেখিয়ে বসানো কোনভাবেই দলের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। এতে বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকানোও সম্ভব হবে না। বরং হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে বিকল্প পথ বের করতে বেশি তৎপর দলটি। আগামীতে স্বচ্ছভাবে ত্যাগী ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে দলের টিকেট দিয়ে তৃণমূলে বিদ্রোহী প্রার্থিতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল মনে করছে যে, ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য থাকলে দলের শৃঙ্খলা নষ্ট করবে। শৃঙ্খলাহীন সংগঠন তৃণমূলে দুর্বল হয়ে পড়বে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকে অনেকেই দলীয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারেন। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে একাধিক পরিকল্পনা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। তাদের মতে, পৌর বা উপজেলা নির্বাচনের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দ্বন্দ্বের ধরন আলাদা। এখানে পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জে গোত্র-গোত্র গ্রুপিং রয়েছে। তাই বিদ্রোহীদের বুঝিয়ে-শুনিয়েই তাদের নির্বাচন থেকে নিবৃত্ত করার কাজ করে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হবেনÑ এ নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েই গেছে দলটিতে।
×