ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের পিছু ছাড়ছে না

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৬ মার্চ ২০১৬

ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের পিছু ছাড়ছে না

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরী আইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন যে প্রকৃতপক্ষেই বাংলাদেশকে ঘিরে দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের বিশাল এক ষড়যন্ত্র ছিল তা এখন কমবেশি সকলেই বিশ্বাস করেন। যদিও সে সময়ে প্রথম দিকে কেউ সেটা বুঝতে পারেননি। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। সে দিন তা সফল হলে বাংলাদেশের আজকের চেহারা কেমন হতো তা ভাবতেও ভয় লাগে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আনাগোনা ও তৎপরতা তখন ভয়ঙ্কর লেগেছে। কারণ বিশ্বব্যাপী তাদের সুঁই হয়ে ঢোকা আর ফাল হয়ে বেরোনোর কথা সকলেই জানেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং বড় রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সেই ষড়যন্ত্র রুখে দেয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার গ্রেফতারের মাধ্যমে সে সময় ষড়যন্ত্রের স্বরূপটা প্রথম মানুষের কাছে ধরা পড়ে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই অতি প্রত্যুষে শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের মধ্যে ১৩টি গাড়ির বহর নিয়ে যৌথবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত অসৌজন্যমূলকভাবে গ্রেফতার করে শেখ হাসিনাকে। তখন একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এহেন গর্হিত ও অমানবিক আচরণের নিন্দা জানায় বিশ্ববিবেক। আদালতে দাঁড়িয়ে সেদিন শেখ হাসিনা প্রায় আধা ঘণ্টা বক্তব্য রাখেন। সেই বক্তব্যের ভেতরে যে অদম্য সাহস, আত্মবিশ্বাস এবং অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ পায় তাতে সেদিন মানুষ বুঝতে পারে শেখ হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের মতো গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীরাও এক নম্বরে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে পারলে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে মনে করে। তা না হলে যেসব অভিযোগে সেদিন শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয় তার সব অভিযোগই আরও অধিক মাত্রায় প্রযোজ্য ছিল অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বেলায়। তাছাড়া পূর্বে সেই পাকিস্তান আমল এবং অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে। সেখানে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের যে গতানুগতিক অভিযোগগুলো আনা হয়ে থাকে তা সব সময়ই দেখা গেছে প্রথমে আসে অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকারের নেতা-নেত্রীদের ওপর। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে, যার কোন গ্রহণযোগ্য কারণ তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কেউ বলতে পারেনি। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের প্রায় দুই মাস পর বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তখন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সচিবালয়ের বারান্দায় কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে একটু বাঁকা হাসি দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সমান করে দিলাম, তাই এখন আর কারোর কোন অভিযোগ থাকা ঠিক নয়। তাছাড়া অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে সময়ের বিবেচনাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি ব্রাকেটে বন্দী করা হয়েছিল। দেখা গেল, ১৯৯৬ সালের পরবর্তী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে। শেখ হাসিনাই যে তাদের অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তা বোঝা যায় শুধু একটি প্রশ্ন করলে। ১৯৯১ সাল থেকে বা তারও পূর্বে ১৯৮২ সালের এরশাদের আমল থেকে সময়ের ব্রাকেটটি শুরু হলো না কেন? কেন সেটা ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হবে। এর কি কোন যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। সব ধূম্রজালকে ভেদ করে মানুষ দেখতে পায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ছায়া পড়েছে। তাদের কার্যক্রমে বাংলাদেশের নয়, বৃহৎ পরাশক্তির ভূ-রাজনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থ হাসিল হবে বলে মানুষের কাছে মনে হতে থাকে। তার কিছু আলামতও তখন দেখা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকে গণতন্ত্রের মোড়কে দীর্ঘায়িত করার জন্য ভুঁইফোঁড় ব্যক্তিদের মাঠে নামিয়ে গঠন করা হয় একাধিক কিংস পার্টি। কি দাপট, জরুরী আইনে সব রাজনীতি বন্ধ থাকলেও কিংস পার্টি মোটরসাইকেল মিছিল করে, রাস্তায় পুলিশ তাদের ছালাম করে কুল পায় না। বড় বড় মিডিয়া হাউস তাদের পেছনে ছুটতে থাকে। এক শ্রেণীর মানুষ বলা শুরু করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার এবার আর রক্ষা নেই। আমার মনে হয়েছে এটাও একটা সুপরিকল্পিত প্রোপাগা-া এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা ছিল। একজন বিশ্ববরেণ্যজনকে রাজনীতির মাঠে নামালে মানুষ তাঁর মধ্যে আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই এবং ইরাকের নূরী আল মালিকের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। সচেতন মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। যারা তখন এদের সমর্থন দিয়েছেন, তারা কি ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিলেন, নাকি অন্য কোন কারণ ছিল, সবকিছু উন্মোচিত হওয়ার আগে তা বলা কষ্ট। জুজুর ভয়ে আর ভুলক্রমে বা বুঝতে ভুল করার জন্য যে কাজ হয় তার সঙ্গে সুপরিকল্পিত কাজের পার্থক্য করা কঠিন কাজ নয়। সামরিক বাহিনী চালিত একটি সরকারের প্রকাশ্য গ্রেফতার ও জীবননাশের হুমকি উপেক্ষা করে যেদিন দেশে ফিরলেন তখন বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার ভেতরে শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। কিন্তু ক্ষমতাধারীরা তখন এক দিকদর্শী দৃষ্টিতে অন্ধ থাকায় মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে না পেরে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। কিন্তু শেষ বিচারে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর ১/১১-এর ষড়যন্ত্রকারীরা পর্দার অন্তরালে চলে যায়। কিন্তু তারা ক্ষান্ত হননি। দেশকাল পাত্রের ভেদ থাকলেও সবক্ষেত্রে দেখা যায় ষড়যন্ত্রের সামনে যারা থাকেন তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হন নেপথ্যের নায়করা। নাটাইয়ের সুতা তাদের হাতেই থাকে। সামনের সারির ষড়যন্ত্রকারীদের কখনও কখনও বিচার হলেও নেপথ্যের নায়করা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। যার ফলে একই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি হয়। নতুন খেলোয়াড়দের সামনে এনে নতুন কৌশলে মাঠে নামেন নেপথ্যের নায়করা। একটি ইংরেজী পত্রিকার সম্পাদকের ওই সময়ের ভূমিকা সম্প্রতি আলোচনায় আসায় নতুন করে আবার ১/১১-এর ষড়যন্ত্রের কাহিনী সম্পর্কে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। ১/১১-এর সামনের ও পেছনের কর্মকারদের পরিকল্পনা সফল হলে আজ সকলেই ভিন্ন কথা বলতেন। সাময়িক লাভের জন্য খলনায়কদের ফুলের মালা দেয়ার লোকের অভাব হয় না। খন্দকার মোশতাকও এক সময় ফুলের মালা পেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর জুতার মালাই তার ভাগ্যে জুটেছিল। ক্ষমতা আর ভোগ বিলাসের লোভে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ২০০৭-২০০৮ সময়ের ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হলে বাংলাদেশের চেহারা আজ কেমন হতো তা কেউ বুঝতে চাইলে তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে ২০০১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন কেন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, কেনইবা তিনি তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন। রাষ্ট্রের স্বার্থেই অনেক রাষ্ট্রীয় ব্যাপার গোপন থাকে। শত বছর পর অথবা তারও পরে কোন এক সময়ে সেটি প্রকাশ করা হয় যখন ওই ইস্যুটি সম্পূর্ণরূপে প্রাসঙ্গিকতা হারায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ষড়যন্ত্রের যারা ভিকটিম তারা পরবর্তীতে সুযোগ ও ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পরেও নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ পরিপূর্ণভাবে উন্মোচন করতে পারেননি অথবা বৃহত্তর স্বার্থে সেটা করা থেকে বিরত থেকেছেন। ১৯১৮ সালের ৩০ আগস্ট লেনিনকে হত্যা চেষ্টার সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার হন জাপানী অর্থে পরিচালিত এ্যান্টি বলশেভিক সন্ত্রাসী সংগঠনের একজন নারী সদস্য ফ্যানি কাপলান। কিন্তু রহস্য উদ্্ঘাটনের আগেই গ্রেফতারকারীদের হাতে নিহত হন কাপলান। ওই ঘটনার পর লেনিন ৬ বছর বেঁচে ছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু নিজের হত্যা রহস্য উদ্্ঘাটনের আগে সন্দেহভাজন আক্রমণকারীকে কেন গুলি করে মারা হলো এবং তার পেছনে কোন ষড়যন্ত্র ছিল কিনা তা আজও রাশিয়ার মানুষ জানে না। ২০০৭-২০০৮ সময়ে কারা জুজুর ভয়ে আর কারা স্বইচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছেন সেটা আইন আদালতে প্রমাণ করা হয়ত কঠিন কাজ। কিন্তু দেশের মানুষ বুঝেছে এবং তাদের ভাল করে চিনেছে। তারা তখনও স্বইচ্ছায় ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছেন এবং এখনও সেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। এদের নতুন একটি রূপ আবার দেখা যায় পদ্মা সেতুর ঋণ যখন মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বাতিল করে দেয়। তখন ১/১১-এর কুশীলবগণ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মহাশোরগোল তোলে, প্রচার চালায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে ভয়ানক দুর্নীতি হয়েছে অথচ একটা টাকাও যেখানে ছাড় করা হয়নি, খরচ করা হয়নি সেখানে দুর্নীতি হয় কি করে। এই মৌলিক যুক্তিটিও তখন তারা আমলে নেয়নি। এখন এটা প্রমাণিত হয়েছে ওই দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ও মিথ্যা। ১/১১-এর নায়করা বিশ্বব্যাংকের কোরাসে যোগ দেয়ায় এটা স্পষ্ট হয় পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন ছিল ওই ১/১১-এরই বর্ধিত ষড়যন্ত্র। উদ্দেশ্য শেখ হাসিনার সরকারকে বদনামে ফেলা এবং অজনপ্রিয় করা, যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় না আসতে পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে দেশী নিরপেক্ষধারী কুশীলব ও বৃহৎ শক্তির তৎপরতাই আমার উপরোক্ত মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করে। উল্লিখিত দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের আরেকটি সম্মিলিত রূপ সম্প্রতি দেখা গেছে। গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা ও জাপানী নাগরিক হোসি কোনিও হত্যাকা-ের পর এই একই গোষ্ঠী বাংলাদেশে আইএস এসে গেছে এটা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। আইএস বাংলাদেশে আছে এটা প্রমাণিত হলে তার পরিণতি কি হতে পারে তা আমরা সকলেই বুঝি। ২০০৭-২০০৮ সময়ে যে উদ্দেশ্য সফল করা যায়নি, সেটি সফল করার একটা সুযোগ আবার দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের হাতে চলে আসে। একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে খন্দকার মোশতাক ও মাহবুব আলম চাষীরা বাংলাদেশকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করে। তার ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় বঙ্গবন্ধু ও জেলের ভেতরের চার নেতা হত্যাকা- এবং চলে দুই সামরিক শাসকের দীর্ঘ ১৫ বছর দেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৭-২০০৮ সময়ের দেশী-বিদেশী চক্রান্ত ইত্যাদি ষড়যন্ত্রই একই সূত্রে গাঁথা। সব ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে নেই করা এবং তার জন্যই শেখ হাসিনাকে মাইনাস করা, সে যেভাবেই হোক না কেন। যড়যন্ত্রকারীরা এখন ধনেজনে, মিডিয়ায় এবং বিদেশী সহযোগিতায় অনেক শক্তিশালী। সহজে তাদের কাবু করা যাবে না। তাই অনেকেই মনে করেন ষড়যন্ত্র সহজে বাংলাদেশের পিছু ছাড়ছে না। সুতরাং সব জায়গায় সবাইকে সতর্ক হতে হবে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×