ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জে থামছে না খুন, আতঙ্কে বাসিন্দারা

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নারায়ণগঞ্জে থামছে না খুন, আতঙ্কে বাসিন্দারা

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ রাজধানী ঢাকার পার্শ¦বর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জে খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এই জনপদের মানুষের মধ্যে এখন খুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বশেষ ১৯ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে স্ত্রী ও শাশুড়িকে জবাই করে হত্যা করে এক যুবক। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি রাতে শহরের ২নং বাবুরাইল এলাকায় ফ্ল্যাট বাসায় দুটি অবুঝ শিশুসহ পাঁচজনকে শ্বাসরোধে ও পুতা দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে পাষ- মাহফুজ। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঘটে চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের ঘটনা। তাই স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, সাত খুনের পর থেমে নেই খুনের ঘটনা। ফলে বার বার এ জনপদের বাসিন্দাদের দিন-রাত কাটে খুন আতঙ্কে। জানা গেছে, সর্বশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে সোনারগাঁও উপজেলা কাঁচপুরের উত্তরপাড়া এলাকায় গার্মেন্টসকর্মী কাউসার মিয়া পারিবারিক কলহের জের ধরে প্রথমে তার স্ত্রী শারমিন আক্তার লাভলী ও পরে তার শাশুড়ি রাশিদা বেগমকে জবাই করে নৃশংসভাবে খুন করে। এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দরা ঘাতক কাউসার মিয়াকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অবশ্য কাউসার মিয়া অকপটেই এ হত্যার দায় স্বীকার করে স্থানীয় সাংবাদিকদের সামনে বর্ণনাও দিয়েছে। এ ঘটনায় কাঁচপুর এলাকায় খুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবার গত ১৬ জানুয়ারি রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের ২নং বাবুরাইল এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে একই পরিবারের তাসলিমা বেগম, মেয়ে সুমাইয়া, ছেলে শান্ত, তাসলিমার জা লামিয়া ও তাসলিমা ভাই মোরশেদুল ওরফে মোশারফকে নৃশংসভাবে খুন হয়। হত্যার পরদিন ১৭ জানুয়ারি নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় পুলিশ নিহত তাসলিমার স্বামী ও এ মামলার বাদী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে গ্রেফতার করে মাহফুজকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাবাসাবাদ করে। হত্যাকা-ের ৫ দিনের মাথায় এ পাঁচ খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। মাহফুজ পুলিশ ও আদালতের কাছে পাঁচ খুনের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। মাহফুজ একাই পুতা দিয়ে ও শ্বাসরোধ করে একে একে তাসলিমা, তার ভাই মোরশেদুল, তাসলিমার জা লামিয়া, মেয়ে সুমাইয়া ও ছেলে শান্তকে হত্যা করে। এ হত্যাকা-ের রোমহর্ষক বর্ণনা দেয় মাহফুজ। এদিকে ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের বাড়িতে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শামীমা আক্তার, শ্যালক রানা, গৃহপরিচারিকা মনি ও রেখাকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় শামীমার ভাই মামুন বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। কিন্তু এ মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট শহরের পাইকপাড়া এলাকায় আমেনা মঞ্জিলে ফ্ল্যাট বাসায় মাবিয়া বেগম ও তার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া আক্তারকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় মাবিয়ার ভাই নুরুল হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে ওই বছরের বিভিন্ন সময়ে তিন আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত হিরু মালিক এবং ওমর ফারুক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত তিনজনকে মৃত্যুদ- দেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম লিটন, চন্দ্রন সরকারের প্রাইভেকটকার চালক ইব্রাহিম ও স্বপনের প্রাইভেটকার চালক জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করা হয়। ৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম লিটন, চন্দন সরকারের প্রাইভেটকার চালক ইব্রাহিম ও স্বপনের প্রাইভেটকার চালক জাহাঙ্গীরের লাশ ও ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার চার সহযোগী হত্যার ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী সংস্থা নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে রয়েছেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি আদালত নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে। এখন শুরু হবে বিচারকার্য। এদিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে গত তিন মাসে চার শিশু শিক্ষার্থীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর উপজেলার প্রভাকরদী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সোহাগ (১৪) বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া কালাপাহাড়িয়া গ্রামের বখাটে কামরুলের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গত ১৯ অক্টোবর রাতে খুন হয় পূর্বকান্দি গ্রামের মাদ্রাসাছাত্রী শারমীন (১৬)। ওইদিন রাতে কামরুল দুই সহযোগীসহ শারমীনকে গণধর্ষণের পর শ^াসরোধে হত্যা করে লাশ বাড়ির পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় তিনজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। অপরদিকে আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের গিরদা গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী হযরত আলীর মেয়ে শিশু শ্রেণীর ছাত্রী হাফছা আক্তার রূপা (৫) গত ২৬ নবেম্বর সকালে স্কুলে গিয়ে আর ফেরেনি। ওইদিন রাতে একই গ্রামের লতিফ মেম্বারের ছেলে ফজলে রাব্বি (১৬) মোবাইল ফোনে রূপার পরিবারের কাছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। রূপার পরিবার বিষয়টি পুলিশকে জানালেও শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি তারা। এদিকে মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে ওই রাতেই অপহরণকারীরা রূপাকে হত্যা করে লাশ তার বাড়ির পাশে ফেলে রেখে যায়। এ ব্যাপারে নিহতের মা লিপি আক্তার বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুজনকে অজ্ঞাত পরিচয় উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন। এ ছাড়া অপহরণের ছয় দিনের মাথায় উপজেলার ইদবারদী গ্রামের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদের (১১) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এভাবেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের পর হত্যার ঘটনা বেড়েছে বলে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোখলেছুর রহমান জানান, পারিবারিক ঘটনার জের ধরে ও ভুল বোঝাবুঝির কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। কোন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে খুনের ঘটনা ঘটছে না।
×