১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য দুটি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। সে সুবাদে বাঙালী মুসলমানদের প্রত্যাশা ছিল স্বাধীন পূর্ববাংলার এবং সেজন্য ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার জনগণ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম লীগকে ভোট দেয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ বড়লাট ভারত বিভাগ এবং পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে এক পাকিস্তানের পরিকল্পনায় পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্র সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সে অবস্থায় তা রোধ করার কোন উপায় ছিল না, কেননা তখন ধর্মপ্রাণ সাধারণ বাঙালী মুসলমানরা ছিল পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর। দেশ বিভাগের পূর্বে ছাত্রদের একমাত্র সংগঠন ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭-এর আগস্টে এই সংগঠনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মাত্র একুশ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কামরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আবদুল অদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হয়। এর কারণ ছিল বাঙালীর ভাষা, কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। এরা আগেই অনুমান করেছিলেন মুসলমানদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে।
উল্লেখ্য, কলকাতায় ছাত্রদের দুটি গ্রুপ ছিল। একটি শেখ মুজিব, অপরটি শাহ আজিজের নেতৃত্বে। ঢাকায় এসে শাহ আজিজ গ্রুপ সরকার সমর্থক হয়ে যায়; কিন্তু শেখ মুজিবের অংশ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে এক সভায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে পুনর্গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’-এ লিখেছেন, ‘ঐ সভায় শেখ মুজিব উপস্থিত না থাকলেও তাকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করা হয়। শেখ মুজিব তা শুধু মেনেই নেননি, বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক জন্মের আগেই এবং তা ১৯৪৭ সালের ১৮ মে প্রকাশ্যে লাহোরে হায়দ্রাবাদে উর্দু সম্মেলনে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের ঘোষণা ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা’ (দৈনিক আজাদ, ১৮ মে ১৯৪৭)। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজ পত্রিকায় এক সংবাদে প্রকাশ করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। কায়েদে আযম সকাশে জমিয়ত প্রতিনিধিদের স্মারকলিপিতে ‘পূর্ববঙ্গের জনগণ উর্দুর সমর্থক বলে দাবি করা হয়’ (দৈনিক আজাদ, ২৬ মার্চ ১৯৪৮)।
২৮ ফেব্রুয়ারি ৪৮ তমুদ্দিন মসজিদ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় ভাষার দাবিতে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান সম্মিলিত এক বিবৃতিতে সই করেন শেখ মুজিব, নইমুদ্দিন আহম্মদ, আ. রহমান চৌধুরী। ওইদিন পিকেটিং করেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ। এবং সে সময় তারা বন্দী হন। কিন্তু প্রতিবাদ মিছিল বের হয় বেলা দুটোর দিকে।
১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমন উপলক্ষে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ১৫ মার্চ, ১৯৪৮। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সব ক’টি দাবি মেনে নেন, এমনকি নিজ হাতে লিখে নিম্নলিখিত শর্তটি যোগ করেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা জেলখানায় বন্দী নেতাদের দাবিগুলো দেখান এবং তাদের অনুমতিক্রমে গ্রহণ করেন। এসব দাবিতে ছিল-
১। অদ্য পাঁচ ঘটিকায় সকল রাজবন্দীর মুক্তি।
২। ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা ও অন্যান্য খবরের কাগজের ওজর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওইদিনই তুলে নেয়া হয়।
৩। আজই ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
৪। আজই ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অনুমোদনসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে।
৫। পুলিশী নির্যাতনের জন্য ইনকোয়ারী কমিশন করা এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে।
৬। যে সকল গু-া শ্রেণীর লোক আন্দোলনে ছাত্রদের মারপিট করেছে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।
৭। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কোন ছাত্র বা অন্য কাউকে ‘ভিকটিম’ করা হবে না।
উপরোক্ত দাবিগুলো ছাত্রদের আগেই তৈরি করা ছিল। আলোচনার সময় আরও যে নতুন দাবি ওঠে তা খাজা নাজিমুদ্দিন নিজ হাতে লিখে ৮ নম্বর শর্ত বলে মেনে নেন।
৮। সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলোচনার পর এই মর্মে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।
খাজা নাজিমুদ্দিনের চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিব প্রমুখরা মুক্তি পান। ঐ সময় অন্যান্য বন্দী রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায় প্রমুখের অন্য মামলার অজুহাতে মুক্তি দিতে সরকার অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বন্দীরা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে চাপাচাপি করলে ১৫ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে বন্দীদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়। (বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস-মোহাম্মদ হান্নান, পৃঃ ৪২)।
পরদিন ১৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভা হয়। সভায় ১৫ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তার কিছুটা সংশোধন করা হয়।
১। ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করা-
২। পরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রাখার জন্য দিন ধার্য-
৩। সংবিধান প্রণয়ন (গণপরিষদ) সভায় উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হইলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা-।
প্রস্তাবগুলো পাস করার পর তা অলি আহাদকে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সভায় শেখ মুজিব জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। সেদিন কোন মিছিল করার কর্মসূচী না থাকলেও ‘চলো চলো এ্যাসেম্বলী চলো’ বলে শেখ মুজিব এক বিরাট মিছিল নিয়ে এ্যাসেম্বলী হলের দিকে অগ্রসর হন। তখন পরিষদের অধিবেশন চলছিল। পরবর্তী ব্যবস্থাগুলোতে ১১ মার্চ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতে থাকে। আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ববঙ্গে জুলুম প্রতিরোধ হিসেবে পালিত হয় ধর্মঘটের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় ময়দান সভায় নইমুদ্দিন আহম্মদ সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিব, আ. রহমান চৌধুরী প্রমুখ। পরে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন করায় শেখ মুজিবসহ ২৭ শিক্ষার্থীর ওপর বহিষ্কারাদেশসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। শেখ মুজিব তখন আইনের ছাত্র। তার শাস্তি হয় মুচলেকা এবং ১৫ টাকা জরিমানা, না হয় চূড়ান্ত বহিষ্কার। শেখ মুজিব মুচলেকা দেননি, তাই বহিষ্কার এবং ছাত্রজীবন শেষ। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিলে নেতৃত্বদানের সময় শেখ মুজিব বন্দী হন এবং মুক্ত হন ২৬ ফেব্রুয়ারি ’৫২ সালে। তবে এ সময় তার মুক্তির দাবিতে পোস্টার, স্লোগান, লিফলেট, স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে (তখনও দৈনিক হয়নি) ‘কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমান’ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন রয়েছে।
মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৩১ জানুয়ারি ’৫২ সালে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরী হলে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সভায় অবিলম্বে নিরাপত্তা বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য বন্দীমুক্তি ও নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ রহমতুল্লাহ ক্লাবে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায়ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক শেখ মুজিব ও মহীউদ্দিন আহম্মদ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি ’৫২ আমরণ অনশন শুরু করেন। তখন অসুস্থতার কারণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয় তাদের। বন্দী অবস্থায় অবশ্য সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দেন। এ সময় ১৭ ফেব্রুয়ারি ’৫২ ইত্তেফাকে এক প্রতিবেদনে ‘পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গী কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে কারাবাস ও বন্দী দিনগুলোর নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য উৎকণ্ঠা ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদেশের সকল কর্মী বিশেষ করিয়া শেখ মুজিব ও মহীউদ্দিনের আশুমুক্তির জন্য আবেদনপত্র পেশ করিয়াছেন। আবেদনপত্রে মওলানা ভাসানী, বিশিষ্ট ছাত্রনেতাসহ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা সই করেন। মানবতার নামে শেখ মুজিব ও মহীউদ্দিনের মুক্তির আবেদন জানিয়ে মওলানা ভাসানী একটি পৃথক বিবৃতি দেন, যা ২৪ জানুয়ারি ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রাজবন্দী মুক্তি কমিটির সভায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে প্রস্তাব নেয়া হয় এবং পোস্টার দেয়া হয়।
১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলন হয় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে। অপরাহ্ণ আড়াইটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আপনারা সংঘবন্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাসিম ও অন্যান্য কর্মী আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই, ভাষা চাই। রাষ্ট্রভাষার ওপর গণভোট দাবি করে শেখ মুজিব বলেন, ‘মুসলিম লীগ, লীগ-সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলাভাষা চায়।’ এই সম্মেলনে মোট ২২টি প্রস্তাব নেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ৫ ডিসেম্বর ’৫২ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সভা-সমিতির মাধ্যমে বন্দীমুক্তি প্রতিটি শাখাকে পালনের জন্য সম্পাদক শেখ মুজিব নির্দেশ দেন। ঐ দিন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে বিরাট জনসভা পরিষদের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিব বলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে মওলানা ভাসানীসহ বহু কর্মী বিনা বিচারে জেলে আটক আছেন। ভাষার দাবিতে গোলাগুলি চলে কিংবা এরূপ বন্দী করা হয় এই দুনিয়ার ইতিহাসে এটাই তার প্রথম নজির। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ছাড়াও জনতার দাবি নিয়ে যারা সংগ্রাম করছিলেন তাদের অনেককে সরকার ইতিপূর্বে বিনা বিচারে আটক রেখেছেন। অবিলম্বে সকল বন্দীকে মুক্তি না দিলে দেশব্যাপী গণআন্দোলন সৃষ্টি হবে। তিনি দেশবাসীর স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দাবি করেন। উপসংহারে বলেন, ‘মওলানা ভাসানী ও সহকর্মীরা জেলে পচে মরলে আমরা বাইরে থাকতে চাই না।’
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে যে কর্মসূচী নেয় তা পালনের জন্য আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিব নির্দেশ দেন। ঐদিন সকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহরে টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। তার অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা প্রথম গানটি ‘ভুলবো না...’ পরিবেশন করেন। সভায় অন্যান্য স্লোগানের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক ইত্যাদি এবং চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মার্চ মাসে। যুক্তফ্রন্টের জনপ্রিয়তা তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং সে সুবাদে একুশে ফেব্রুয়ারি যাতে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত না হতে পারে তার জন্য লীগ সরকার নির্যাতন তীব্রতর করে। ছাত্রীসহ অনেক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। যার বিরুদ্ধে শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ঐ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। আবার ২০০০ সালে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার গভীর আগ্রহে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করে। আর শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে চলেছেন (সর্বশেষ ২০১৫) পিতার মতোই। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, এদেশে কতিপয় ভাষাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কুলাঙ্গার শহীদ মিনার ভাংছে এবং শোকের মাস, বিজয়ের মাসে তারা গণহত্যা চালাচ্ছে, পোড়াচ্ছে মানুষ। ওরা ধ্বংস হবেই।
লেখক : গবেষক