ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : গার আলপেবোভিচ ;###;রূপান্তর : এনামুল হক

মার্কিনীরা কি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে!

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মার্কিনীরা কি সমাজতন্ত্রের  দিকে ঝুঁকছে!

আমেরিকার বিশিষ্ট উদারপন্থী অর্থনীতিবিদ জন কেনিথ গলব্রেইথ ১৯৭০ সালে বলেছিলেন, এখন থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির অবশ্যই উচিত হবে ‘সোশ্যালিজম’ শব্দটি ব্যবহার করা। গলব্রেইথ সে সময় কথাটা বলেছিলেন বটে তবে পরবর্তীকালে তিনি বহুলাংশেই এই শব্দটার ব্যবহার বাদ দিয়ে দেন। ইদানীং আমেরিকায় বিশেষ করে প্রাইমারির নির্বাচনী প্রচারে সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র শব্দটা প্রায়শই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহার করছেন মূলত ডেমোক্রেট মনোনয়নপ্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স। সেই সঙ্গে আরও দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার বিপুলসংখ্যক তরুণ ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সমাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। তার মানে একদা যে ধারণাটি আমেরিকানদের কাছে নিষিদ্ধ বস্তুর মতো ছিল এখন আর তা নেই। সাম্প্রতিকতম এক জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, অনূর্ধ ৩০ বছরের ৪০ শতাংশেরও বেশি আমেরিকানের মনোভাব সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুকূল। বলাই বাহুল্য, মনোভাবের ক্ষেত্রে এমন বিশাল পরিবর্তনের সঙ্গত কারণও আছে। আর সেটা হলো সমাজ জীবনের সবেচেয়ে পীড়াদায়ক সমস্যা যেমন ক্রমবর্ধমান অসাম্য, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, চিরস্থায়ী যুদ্ধ, হানাহানি ও অবক্ষয় গতানুগতিক পথে সমাধান করতে গিয়ে সমাজের চরম ব্যর্থতা। আবার অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে উত্তরোত্তর নগ্নভাবে কাজে লাগিয়ে সমাজের এলিটশ্রেণী ও বড় বড় কর্পোরেশনের হাতে সম্পদ ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো হলো কোচ ভ্রাতৃবর্গ ও তাদের দক্ষিণপন্থী মিত্ররা। মার্কিন সমাজে বিরাজমান স্ট্যাটাসকো নিয়ে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ আছে এবং তা থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রতি অনুকূল মনোভাবও বিদ্যমান। সে কারণেই সমাজতন্ত্রের প্রতি এককালের বৈরীভাবের স্থলে এখন দেখা দিয়েছে সমর্থনসূচক ভাব। কিন্তু সেই সমাজতন্ত্র বলতে মার্কিনীরা সত্যি আসলে কি বুঝিয়ে থাকে? সমাজতন্ত্র মানে দেশের সম্পদ এবং বিশেষত মার্সের ভাষায়, উৎপাদনের উপায়গুলোর ওপর সামাজিক মালিকানা। মার্কিনীরা কি এই সামাজিক মালিকানা অর্থে সমাজতন্ত্রকে বুঝে থাকে ও বুঝিয়ে থাকে? অথচ এটাই হলো সমাজতন্ত্রের মূল কথা। আমেরিকানদের প্রচলিত রাজনৈতিক বিতর্কে সম্পদের মালিকানার বিষয়টি কদাচিৎই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ‘রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প’ সংক্রান্ত প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক ধারণাটাও সেখানে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত নয়। ওখানকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রগতিশীলরা বিঘোষিত সমাজতান্ত্রিক মডেলের বিকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা এখনও পর্যন্ত এড়িয়ে চলেছেন। স্যান্ডার্স নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বলে দাবি করে থাকেন। তিনি যে কর্মসূচী দিয়েছেন সেটাকে এক শক্তিশালী উদার বা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কর্মসূচী বলা যেতে পারে। এতে আছে ক্রমানুপাতিক করারোপ, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রমিক মালিকানাধীন কোম্পানির প্রতি তিনি সমর্থন জানিয়েছেন সত্য। তবে শিল্প ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকারের মালিকানার তিনি সুস্পষ্টভাষায় বিরোধিতাও করেছেন। তবে সমস্যা মোকাবিলার প্রচলিত কৌশলগুলোর প্রতি আমেরিকানদের যেমন মোহমুক্তি ঘটছে তেমনি আবার বিকল্প কৌশল গড়ে তোলার মতো নতুন উপাদানও এসে জুটছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। যেমন একটি বিকল্প কৌশল হলো এমন বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে হবে সমাজতন্ত্রী, আবার কাঠামোগতভাবে হবে অতিমাত্রায় গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধ। সেটা হলো গণতন্ত্রায়িত মালিকানা। যেমন শ্রমিক মালিকানাধীন সমবায় সমিতি, মহল্লার ভূমি ট্রাস্ট, পৌর কর্পোরেশন। এগুলো কোন না কোনভাবে মালিকানাকে গণতন্ত্রায়িত করে। তবে সেটা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে না করে বিকেন্দ্রায়িত রূপে করে। এতে যেসব পরিবর্তন ঘটে তা বেশ চিত্তাকর্ষক। শ্রমিক মালিকানাধীন সমবায় সমিতি সাফল্যের বেশকিছু দৃষ্টান্ত আসছে বলে এরা দাবি করেন। শ্রমিক মালিকানার পুরনো কিছু রূপও আছে যেমন এমপ্লয়ী স্টক ওনারশিপ প্ল্যান বা এসপ। গোটা আমেরিকায় প্রায় ৭ হাজার এসপ প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো প্রধানত ১ কোটি ৩৯ লাখ শ্রমিকের মালিকানাধীন। এমন বেশকিছু কোম্পানি আবার এসপ মালিকানার সঙ্গে ইউনিয়নকেও যুক্ত করার চেষ্টা করেছে। আমেরিকার অনেক এলাকায় উৎপাদিত সম্পদের মালিকের সংজ্ঞাটি পরিবর্তিত ও গণতন্ত্রায়িত হচ্ছে। আর সেই পরিবর্তন ও গণতন্ত্রায়নের কাজটা হচ্ছে একেবারেই বিকেন্দ্রীভূত ও অতিমাত্রায় আমেরিকান রূপে। ব্যাপারটা এখনও পর্যন্ত মিডিয়ার খুব একটা দৃষ্ট আকর্ষণ না করলেও বলা যেতে পারে যে প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ আমেরিকান (এদের প্রায় ৩৩ লাখ এখন আর সক্রিয়ভাবে চাকরিতে নেই) কোন না কোন ধরনের সমবায় সমিতির সদস্য। অর্থাৎ এক কোটিরও ওপর নারী ও পুরুষ এমন সব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যেগুলোর মালিক সামগ্রিকভাবে বা আংশিকভাবে তারা নিজেরাই। যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুতশক্তির শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ সরবরাহ করে সমবায় সমিতি বা পৌর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। রক্ষণশীল নর্থ ডাকোটার প্রায় শতাব্দী পুরনো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক সরকারী বা জনগণের মালিকানার মডেলে পরিণত হয়েছে। এর অনুকরণে ফিলাডেলফিয়া, পিটসবার্গ ও নিউ মেক্সিকোয় পৌর মালিকানাধীনে ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় কাজ চলছে। সমগ্র আমেরিকায় গড়ে উঠেছে আড়াইশরও বেশি ল্যান্ড ট্রাস্ট। এগুলো হচ্ছে নগরী ও আশপাশের মহল্লার উন্নয়নের একটা মডেল বিশেষ। এই ল্যান্ড ট্রাস্টের মাধ্যমে জেন্ট্রিফিকেশন প্রক্রিয়া রোধ করার জন্য জমিকে সামাজিক মালিকানায় নেয়া হয়। জেন্ট্রিফিকেশন হলো ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে এলাকায় মধ্যবিত্ত ও বিত্তশালী আগমনের পথ সুগম করে সম্পত্তির দাম বাড়িয়ে দেয়া এবং এইভাবে সেখানকার গবিব ও নিম্ন আয়ের লোকদের হটিয়ে দেয়া। আমেরিকায় কর্পোরেটগুলোর প্রবল বিরোধিতার মুখে প্রায় ৪৫০টি এলাকায় পৌর মালিকানাধীন ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ১৭টি রাজ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পাবলিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিল উত্থাপিত হয়েছে। প্রায় সমসংখ্যক রাজ্যে রাষ্ট্রীয় খরচে স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচী প্রতিষ্ঠার আইন পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। এগুলো সবই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সামাজিক মালিকানার দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্তগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নতুন অর্থনীতির ইঙ্গিত বহন করে যদিও এর কোনটাই এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোন প্রভাব রাজনৈতিক। সামাজিক বা অর্থনৈতিক জীবনে ফেলেনি। তথাপি বড় কথা হলো অনেক অরাজনৈতিক আমেরিকান যাদের মধ্যে প্রচুর রক্ষণশীলও আছে তারাও এ জাতীয় সামাজিক গণতান্ত্রিক মালিকানার বা এমন উদ্যোগের সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা বৃহৎ প্রশাসন, বৃহৎ ব্যাংক, বৃহৎ কর্পোরেশনের বিরোধী। এরাও বিকল্প পথ পেলে তা মেনে নিতে প্রস্তুত। সামাজিক মালিকানা নিয়ে আমেরিকায় আজ যা চলছে তা হলো সীমিত পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এমন এক গমন পথের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যার তাৎপর্য অনেক সুদূরপ্রসারী। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন এই তাৎপর্য একই থেকে যাবে। সরকারী পাবলিক বা গণমালিকানা যে নামেই একে অভিহিত করা হোক না কেন এর পক্ষে যুক্তিটা স্রেফ মুনাফা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আর যাই হোক, বেসরকারী বা ব্যক্তি মালিকানার কর্পোরেশনগুলোকে যেমন ক্রমবর্ধমান মুনাফার চাহিদা মেটানোর জন্য গায়ে গতরে বেড়ে চলতেই হয়, পাবলিক মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোর তা দরকার হয় না। তাদেরকে যে কোন মূল্যে সীমা ছাড়িয়ে যাবার দরকার হয় না। তাছাড়া পাবলিক বা সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠানের চাইতে বেশি। তাছাড়া এগুলোকে রাজনৈতিক প্রচারাভিযানে অর্থায়ন করার বাইরেও রাখা যায়। প্রসঙ্গক্রমে একটি প্রশ্ন আসে। তাহলো বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে কোনটি বাঞ্ছনীয় সরকারী বা সামাজিক মালিকানা, নাকি ব্যক্তি মালিকানা? স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী অর্থনীতিবিদ ই, এফ সুমেখারের মতে, বৃহত্তর পরিসরে ব্যক্তি মালিকানার ধারণাটি অবাস্তব। বিগত আর্থিক সঙ্কটের সময় আমেরিকানরা স্বচক্ষে তা দেখেছে। সে সময় ফেডারেল সরকার বেশ কিছু বৃহৎ ব্যাংক দুটি অটো কোম্পানি ও বৃহৎ বীমা প্রতিষ্ঠান এআইজি কার্যত রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিল। সঙ্কট কেটে যাবার পর আবার সেগুলো ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দেয়। আর এভাবেই এক ধরনের সামাজিক মালিকানার প্রয়োজন অনুভূত হয় যা প্রবৃদ্ধির ওপর বা ওয়াল স্ট্রিটের ওপর নির্ভরশীল নয়। কর্পোরেশনগুলোর ওপর সরকারী মালিকানার কুপ্রভাব নেই তা নয়। এতে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে। তবে এর সার্বিক সুফলের কাছে এই সমস্যাটা তেমন কিছু নয়। আপাতত মার্কিনীরা সে সামাজিক মালিকানার কনসেপ্টের দিকে ঝুঁকছে সে এক মস্ত ব্যাপার। এর যে সব দৃষ্টান্ত বিশেষ করে সমবায়ের বিভিন্ন রূপের কথা কিছুক্ষণ আগে বলা হলো তা আশাব্যঞ্জক। অনেক নগরীর মেয়ররা সমবায়ের অন্যান্য নতুন নতুন রূপের প্রতি সাহায্য সমর্থন যোগাচ্ছেন। অতি আধুনিক ক্লিভল্যান্ডে মহিলা শ্রমিক মালিকানাধীন সমবায় গোষ্ঠী অনেক নগরীর উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। কলরাডোর বোল্ডারে বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর পৌর মালিকানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দুই দুটি গণভোটের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রবল সমর্থন লাভ করেছে। আমেরিকার সরকারী মালিকানাধীন সবচেয়ে বড় একটি প্রতিষ্ঠান হলো টেলিসি ভ্যালি অথরিটি। এ এক বিশাল কর্পোরেশন যা বিদ্যুত উৎপাদন করা ছাড়াও টেনিসি নদী ব্যবস্থার ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। টেনিসি ও আলাবামার ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্যরা এবং অন্য যেসব সদস্য ব্যক্তি মালিকানার প্রতি বিরোধিতা করে এসেছে তারা ঐ কর্তৃপক্ষের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যর্থতা যেখানে দুঃখকষ্ট যন্ত্রণা সৃষ্টি করে চলেছে এবং যেখানে এসব সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ক্রমাগত মুখথুবড়ে পড়ে চলেছে সেখানে এই জাতীয় নানা ধরনের সরকারী বা জনমালিকানা ব্যবস্থা নীরবে নিভৃতে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। রাজ্য ও স্থানীয় সরকারগুলো এসব ব্যবস্থার পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে। এই নতুন কৌশলগুলো সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে এবং সেই পরিবর্তনের বাহন হিসেবে কাজ করতে পারে। এভাবেই এগুলো ক্রমশ চিরায়ত সমাজতন্ত্রের মুখোমুখি গণতান্ত্রিক মালিকানার স্থানীয় রূপের বিবর্তন ঘটাচ্ছে। এভাবে এক সময় তা গণতান্ত্রিক মালিকানাভিত্তিক নতুন রাজনীতির পথ সুগম করতে পারে। [দি নেশন পত্রিকা থেকে সংক্ষেপিত]
×