ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেক্ষিত একুশে -মুহম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

প্রেক্ষিত একুশে   -মুহম্মদ শফিকুর রহমান

বর্ষপরিক্রমায় অমর একুশে আবারও বাঙালীর আঙ্গিনায় উপস্থিত। চলছে নতুন নতুন বইয়ের মিষ্টি সমাহার। প্রতিদিন লেখকদের হায়-হ্যালো চলছে মেলায় মেলায়। প্রখ্যাত লেখক শিক্ষাবিদগণ নবীন-প্রবীণ লেখকদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে চলেছেন যা টেলিভিশনে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা একাডেমির বইমেলা কলেবর বৃদ্ধি করতে করতে আপন আঙ্গিনা ছাড়িয়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান দখল করে নিয়েছে। কেবল ফেব্রুয়ারি মাসের জন্যে। লিপিয়ার হওয়ায় এবারের ফেব্রুয়ারি ২৯ দিনের, অর্থাৎ একদিন বাড়ল। নয়ত ২৮ দিনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ’৫২-তে এসে রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রাঙ্গিয়ে যে পথনির্দেশ দিয়েছিল তারই গৌরবময় পরিণতি আমাদের মহান স্বাধীনতা, আজকের অগ্রসরমান বাংলাদেশ প্রিয় মাতৃভূমি-‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ’৫২-তে আমরা গেয়েছিলাম, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’ না, আমরা ভুলিনি। ৬৪ বছর ধরে আমরা গাইছি এ গান। হয়ত অনন্তকাল গাইব। এ গানের শেষ নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গাইবে বাংলার আকাশ, নদী, খাল-বিল, গাছ-গাছালি, বনের পাখি, কাঠ-বিড়ালীরা। আমরা বাঙালীরা ইতিহাস গড়েছি। ইতিহাস আমাদের সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আমাদের আদর্শ একটি নাম, সে নাম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর হাতের ঝা-া এখন তাঁরই কালজয়ী নেতৃত্বের সাহসী উত্তরসূরি ধরিত্রীর আদরের কন্যা শেখ হাসিনা। ভয় কি মোদের? একুশের স্বপ্ন ছিল। একটি পূরণ হয়েছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দেশে দেশে বিনম্র শ্রদ্ধায় একুশের শহীদদের স্মরণ করা হচ্ছে। এই স্বপ্নপূরণ করতে বাঙালীকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ১৯৪৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি, সময়টি ছিল উত্তাল তরঙ্গময়। প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত ছিল নতুন নতুন উপলব্ধির :Ñ এই প্রথম বাঙালীরা উদ্ভাবন করল তাদের অধিকার সচেতনতার ধান। মানুষ বুঝতে পারল লড়াই করে অধিকার আদায় করতে হয়। তার গণতান্ত্রিক অধিকার, তার রাজনৈতিক অধিকার, তার সাংস্কৃতিক অধিকার। এই প্রথম মানুষ অধিকার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলো। সকল শ্রেণী-পেশা ধর্ম-কর্মের মানুষ। এই প্রথম মানুষ তার ভোট ও ভাতের অধিকারের প্রশ্নে সচেতন হলো। এই প্রথম অধিকার আন্দোলনের ঢেউ শহর, গঞ্জ থেকে বেরিয়ে গ্রামের পর্ণকুটিরে পৌঁছে গেল। এই প্রথম ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ বাংলার কিষান-কিষানির কণ্ঠ থেকে কল-কারখানার শ্রমিকের কণ্ঠে সযতেœ উঠে এলো। ছাত্র-শিক্ষক সংস্কৃতিকর্মীরা ছড়িয়ে পড়ল পথে প্রান্তরে। কবিরা রচনা করলেন নতুন নতুন কবিতা। শিল্পীরা ছবি আঁকলেন। নাট্যজন নাটক লিখলেন। সুচিন্তক বুদ্ধিজীবীরা নেমে এলেন রাজনৈতিক কর্মীদের কাতারে। শিক্ষকরা নেমে এলেন বাংলার কৃষক-শ্রমিকের আঙ্গিনায়, ঘরে ঘরে। এ এক অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থান। এ এক অভাবনীয় জাগরণ। এভাবে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে লেখা হলো স্লোগান- ‘তোমার ভাষা আমার ভাষা-বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- দিতে হবে’, ‘আমার ভাইয়ের বুকে গুলি কেন, জবাব চাই দিতে হবে’, ‘আমার বোনের বুকে গুলি কেন, শাসক শ্রেণী জবাব চাই দিতে হবে’, এভাবে স্লোগানে স্লোগানে ভিনদেশী বিভাষী ক্ষমতার মসনদ অবনতমস্তকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। বাঙালীর অধিকার সচেতনতা অতি অল্পদিনেই বৃহত্তর গণআন্দোলনের পথে এগোতে থাকল- এবার স্লোগান উঠল, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’, ‘তুমি কে আমি কে- বাঙালী বাঙালী’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা’, ‘পি-ি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা’ ‘৬ দফা মুক্তি সনদ- মেনে নাও নিতে হবে’, ১১ দফা মুক্তি সনদ- মেনে নাও নিতে হবে; ‘ জেলের তালা ভাঙব- শেখ মুজিবকে আনব’. ‘জয় বাংলা’। এমনি অসংখ্য স্লোগানের জন্ম হলো। সর্বশেষ দুটি সেøাগান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচনা করল। সেøাগান উঠল- ‘জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান- আজিমপুরের গোরস্তান’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর- সোনার বাংলা মুক্ত কর।’ এভাবে মানবমুক্তির সচেতনতার ভাষার উত্তরণ হতে হতে ‘জয়বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ আজও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ তথা আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভাষা হয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আজকের বাংলাদেশের ওপর আলোকপাত করতে হলে একটু পেছনে তাকাতে হবে। মুঘল সাম্রাজ্যের নিবু নিবু কালের সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলাদেশকে ‘ভারত-স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর পেছনে কারণও ছিল। আওরঙ্গজেব তার শাসনামলের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করে এবং যুদ্ধ করতে করতে যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত এবং আর্থিকভাবে পর্যুদস্ত তখনও একমাত্র সুবে বাংলা বা প্রদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের কর প্রদান অব্যাহত রাখে। ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ছিল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও উন্নত। সুবে বাংলা সমৃদ্ধির কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। ঐতিহাসিক প্রফেসর ড. সুশীল চৌধুরীর মতে, সে সময় বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্য, কুটির শিল্প এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভও ছিল বাংলাদেশ। কাশিমবাজার কুঠির প্রধান জাঁ ল (Jean Law) লিখেছেন, সম্রাট আওরঙ্গজেবের দেয়া নাম ‘ভারত স্বর্গ’ বাংলার যথার্থ অভিজ্ঞান। কিন্তু বাংলাদেশের এই সমৃদ্ধিই বিশ্বের তাবত লুটেরাদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে এবং ধনসম্পদ লুট করার জন্য এসে আর ফেরত যেতে চাইত না। ব্রিটিশ বেনিয়াদের আগমন এবং এখানে বসে ষড়যন্ত্র ও রাজধানী মুর্শিদাবাদের পতনও এভাবেই হয়। ১৬৬০-এর দশকে ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ে (Bernier) যথার্থই বলেছেন- “... the kingdom of Bengal has hundred gates open for entrance, but not a single one for departure. অবশ্য মাঝে মধ্যে মাংসাশী শকুনেরা আমাদের সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এরা ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আবার পাকি-বুটের তলায় পিষ্ট করতে চায়, আবার ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করতে চায়। হত্যা করতে চায় মুক্তবুদ্ধি আর মুক্ত সংস্কৃতির উর্বর ভূমি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝে এসব শকুনের নাম ছিল- জামায়াত, মুসলিম লীগ, ইসলামী ছাত্রসংঘ, এনএসএফ, দালাল-রাজাকার, আলবদর-আলশামস, শান্তি কমিটি, আর আজ তাদের নাম হয়েছে জঙ্গী, হিযবুল মুজাহিদীন, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হামজা ব্রিগেড, জামায়াত-শিবির ইত্যাদি। এদের ছায়া দিচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন হালের ২০ দলীয় জোট। কিন্তু ’৫২-তে বাঙালী যে সচেতনতার ধান বুনেছিল, ৭১-এ তা সোনালি রং ধারণ করে বাংলার প্রতিটি ঘর সমৃদ্ধ করেছে, কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে রাঙ্গিয়েছে পথ-ঘাট কিষানির আঙ্গিনা। ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ এমন এক শক্তির যোগান দিয়েছে যে, বাংলাদেশকে দাবায়া রাখবার শক্তি আর কারও নেই। ঘরে বাইরে কোথাও না। একুশের প্রেক্ষিত তাই আজও প্রাসঙ্গিক। ঢাকা ॥ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×