ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষার চড়াই-উতরাই

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলা ভাষার চড়াই-উতরাই

বাংলা ভাষা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। প্রযুক্তির কারণে এখন রোমান হরফে বাংলা লেখা চলছে। বাংলা ভাষার কার্যত কোন আর্থিক মূল্য নেই বলে মনে করেন উন্নাসিকেরা। একুশ শতকের বাঙালী প্রজন্ম ইংরেজী ভাষার প্রতি যতটা আগ্রহী, বাংলার প্রতি ততটা নয়। তারপরও বাংলা ভাষার দুর্দিন আসছে এমনটা মনে করার কারণ নেই। অবশ্য একুশ শতকে এসে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে- বাংলা ভাষার বিচিত্র ও ঐশ্বর্যময় বিভিন্ন দিগন্ত এখনও ভাষাচর্চাকারীদের দৃষ্টিতে দূরবর্তী রয়ে গেছে। বলা যায়, ভাষার জন্য রক্তদানকারী জাতি ভাষাতত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মৌলিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, জটিল বিষয়ের প্রকাশে বাংলা ভাষা স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করেছে। বাংলা ভাষার সামনে পাহাড়প্রমাণ যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করা যে খুব কঠিন, তা এ প্রযুক্তি উৎকর্ষের যুগে মনে করার কোন কারণ নেই। যদিও ভাষা শুধু তার লিপি ও বাক্যবিন্যাস এবং তার ব্যবহারে অস্তিত্ববান হয়ে থাকতে পারে না, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংস্কৃতি তথা শিল্পকলা, মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার ইত্যাদি। বাংলা ভাষা একটি জীবন্ত ভাষা। কোন স্বাভাবিক ভাষা বেঁচে থাকার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো তার শব্দভা-ারের ক্রমিক বিস্তার। চলমান জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে নতুন শব্দ ভাষার শব্দভা-ারে ক্রমাগত জড়ো হতে থাকে। তাহলে সে ভাষা জীবন্ত, যা প্রাণস্পন্দে স্পন্দিত। এ শব্দ আসে নানা পথে, নানাভাবে, নানা কারণে, নানা উদ্দেশ্যে। ভাষা ব্যবহারকারীরা তাদের জীবনযাপনের নতুন নতুন প্রয়োজন মেটাতে তৈরি করে কিংবা ধার করে নতুন শব্দ। কখনওবা পুরনো শব্দগুলোকে নতুন অর্থে ও নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করে। এসবই হচ্ছে ভাষার বেঁচে থাকা ও অগ্রগতি এবং বিস্তার ও উন্নতির লক্ষণ। বাংলা ভাষায়ও সে অর্থে শব্দভা-ার ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। নতুন নতুন শব্দ আসছে এ ভাষায়। আবার বহু ব্যবহারে জীর্ণশীর্ণ ক্লান্ত হয়ে অনেক শব্দ বিলুপ্ত বা মৃত হয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি তথা কম্পিউটার ও সেলফোনে যথাযথভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে সম্প্রসারিত করা গেলে ভাষাচর্চার আরও ব্যাপক বিকাশ ঘটতে পারে। বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ, গবেষণা ও ব্যবহারে প্রযুক্তিগত সহায়তা ক্রমশ কার্যকর হচ্ছে। ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ, বানান সমস্যা, বাক্য গঠন প্রক্রিয়া, যথাযথ শব্দ প্রয়োগ- ইত্যাকার বিষয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি সহায়ক হয়ে উঠছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নিত্য ব্যবহৃত লিখিত বাংলা ভাষার বিস্তৃত নমুনা ও প্রমাণ জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ বা তুলে এনে কম্পিউটারে জড়ো করা সম্ভব। ভাষাচর্চার প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বাংলা ভাষাকে বের করে এনে এর শরীরে নয়া প্রাণসঞ্চার সম্ভব। কারণ বাংলা ভাষা দুর্বল কোন ভাষা নয়। এর শক্তিমত্তা যথেষ্ট। দুই শ’ বছর আগে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা ও বহু ভাষাবিদ উইলিয়াম কেরি অভিমত জানিয়েছিলেন বাংলা ভাষা সম্পর্কে- ‘এই ভাষা প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের তুল্য এক বৃহৎ ভূভাগে প্রচলিত এবং যথোচিত অনুশীলন হইলে স্বতঃসিদ্ধ সৌন্দর্য ও সুস্পষ্টরূপে ভাব-ব্যঞ্জনায় ইহা জগতের কোন ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইবে না।’ স্বীকার করতেই হবে অমর কথার বাহনস্বরূপ যে সকল শ্রেষ্ঠ ভাষা জগতে বিদ্যমান বাংলা ভাষা তার অন্যতম। বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন রয়েছে, কেবল অফিস-আদালত ছাড়া। গত চার দশকের বেশি সময়ে যা সম্ভব হয়নি। তবে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা যে দিনে দিনে ঐশ্বর্যম-িত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
×