ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শাহজাহান মণ্ডল

রায় লেখা বিতর্ক ও বিএনপির কল্পনার ফানুস

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

রায় লেখা বিতর্ক ও বিএনপির কল্পনার ফানুস

কে নাকি স্বপ্নে গরুর গাড়িতে চাঁদে গিয়েছিল। শুনে তার বন্ধু বলেছিল, স্বপ্নেই যদি যাবি আর চাঁদেই যদি যাবি তো গরুর গাড়িতে ক্যান্, রকেটেই যেতে পারতিস! বিএনপির নেতারা গল্পটা থেকে ভালই সবক নিয়েছেন মনে হয়। আওয়ামী লীগ আর মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে ছোটখাটো অভিযোগ তুলে লাভ কী? সিটি কর্পোরেশন, পৌর নির্বাচন বা অন্যান্য ঠুনকো বিষয় নিয়ে এখন আর কথা বলে লাভ নেই মনে করে এবার তাঁরা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বর্ষপূর্তির বাণীর একটি প্রশাসনিক কথাকে তৈলাক্ত বাঁশ ধরে নিয়ে তা বেয়ে উঠতে শুরু করেছেন। উদ্দেশ্য মাথায় ওঠা, উদ্দেশ্য সরকার পতন, উদ্দেশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা। বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের ভ্রান্ত যুক্তির ওপর তাঁরা ভর করছেন। যদিও ঐ উকিল বন্ধুরা জানেন, যা বলছেন তা সত্য নয়, মিসলিডিং আর ভিত্তিহীন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা হয়তোবা বিচারকদের কাজের প্রতি তাগিদ দেয়ার জন্য এমন কথা উল্লেখ করেছেন। বিএনপির বিগ লিডার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন আর সেক্রেটারি মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেই বসলেন, এস কে সিনহার কথাই ঠিক; তাঁর কথা মোতাবেক সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক যে চেয়ারে থেকে সংবিধানের পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে রায় ঘোষণা করেন এবং অবসরে যাবার পর রায় লেখেন তা অবৈধ ও অসাংবিধানিক। স্মরণ করা যেতে পারে, সংবিধানের ওই পঞ্চম সংশোধনী বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধকারী পঁচাত্তরের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে যথার্থ বলেছিল; আর মোশতাক-জিয়ার সামরিক সরকারকে বৈধতা দান করেছিল। আবার ত্রয়োদশ সংশোধনী তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু করেছিল। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের দেয়া রায়ের পর পার্লামেন্টে ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার পর নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তাই ‘তত্ত্বাবধায়ক, তত্ত্বাবধায়ক’ বলে মুখে ফেনা ছোটানো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলও দাবি করে বসলেন, খায়রুল হকের অবসরে গিয়ে লেখা রায় অসাংবিধানিক। তাই সিনহা বাবুর ‘বাণী’ সূত্রে এ সরকার অবৈধ। কী চমৎকার সমীকরণ। পৃথিবীর কেন্দ্রে যে লাভা তার ওপর ভূপৃষ্ঠ, ভূপৃষ্ঠের ওপর আমি দাঁড়িয়ে, অতএব আমিও লাভার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আহারে আহøাদ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার খোদ বাণীটিই আসলে সাংবিধানিক ও আইনসম্মত কি-না তা নির্ধারণ করা এক্ষেত্রে জরুরী। যদি এস কে সিনহার বক্তব্য ঠিক হয় তাহলে সাংবিধানের ৫ম, ৭ম, ১৩তম ও ১৫তম সংশোধনী মামলার রায়, জেলহত্যা মামলার রায়, মাজদার হোসেন মামলার রায় (যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথক হয়) সহ বহু রায় প্রশ্নবিদ্ধ হবে! দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে। তাই ২১.০১.২০১৬ তারিখের জনকণ্ঠের লিড নিউজ ছিল ‘সাংবিধানিক সঙ্কট’। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, প্রধান বিচারপতি তাঁর প্রশাসনিক নির্দেশ দ্বারা এ ধরনের ফরমান জারি করতে পারেন না। এটা করতে হলে অবশ্যই আদালতের ঘোষিত বিচার বিভাগীয় আদেশ থাকতে হবে। প্রধান বিচারপতি তাঁর প্রশাসনিক আদেশ বলে সংবিধান ব্যাখ্যা করতে পারেন না। তিনি যে কথা বলেছেন তা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং বেআইনী। তাঁর এই উক্তির পেছনে আদৌ কোন সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি নেই। কারণ একজন বিচারপতি রায়টা দেন বিচারপতি থাকা অবস্থায়। অনেক সময় তিনি অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়টি লেখেন মাত্র। এই পদ্ধতিই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে। আমরা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিকের কথা সমর্থন করি। কারণ, বিচারপতিরা ভরা আদালতে রায় দেন, সংক্ষেপে রায়টি শোনান, আমরাও মূল কথাটি শোনার জন্য এজলাসে বসে থাকি, রায় শুনি। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিস আওয়ারে তাঁর পক্ষে সারাদিনের সমস্ত মামলার অর্ডার ও রায় সময়ের অভাবে লেখা সম্ভব হয় না বলে তিনি বাসায় বসে বাকি লেখার কাজ সম্পন্ন করেন। এই সুযোগটি তাঁকে না দিলে এবং তিনিও না নিলে মামলাজট দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যেত বিশ্বব্যাপী। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা সবখানেই হতো এ অবস্থা। কারণ সব দেশেই রায় ঘোষণার স্থান প্রকাশ্য আদালত, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা হয় পরে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং বর্তমান এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কণ্ঠেও বিচারপতি মানিকের প্রতি সমর্থন রয়েছে, এস কে সিনহার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন নেই। আমরা এও জানি, এজলাসে রায় ঘোষণার পর একজন বিচারপতি পরে লিখে কমপ্লিট করেন, কিন্তু তাতে স্বাক্ষর দেন না; কারণ তা ঘোষণাটিরই লিখিত ও পূর্ণাঙ্গরূপ। স্বাক্ষর দিলেও তা হয় রায় ঘোষণার তারিখ। উপরন্তু, রায়ের ঘোষিত রূপ ও লিখিত রূপের মধ্যে বিরোধিতা থাকে না। তাই যদি হয় তাহলে রায় লিখতে দুমাস-দুবছর যাই দেরি হোক না কেন এবং বিচারপতি চাকরিতে বা শপথে থাকুক বা না থাকুক তাতে কোন আইনগত প্রশ্ন ওঠার সুযোগই থাকে না। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্যটি যে আসলে সমর্থনযোগ্য নয় তা বোঝা যায় আইনের সাংবিধানিক সংজ্ঞা থেকে। এদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই ১৯৭২-এর সংবিধান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের এ সংবিধানের ১৫২ নম্বর অনুচ্ছেদে আইন বলতে যে কোন এ্যাক্ট, অর্ডিন্যান্স, বাই লজ, রুলস্, রেগুলেশনস্, গেজেট নোটিফিকেশনসের পাশাপাশি আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কোন প্রথা ও ব্যবহার বিধিও অন্তর্ভুক্ত। কাজেই আমরা যখন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ সকল দেশে দেখি যে, বিচারপতিগণ এজলাসে রায় ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায় পরে লেখেন, তখন বোঝা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রথা সকল রাষ্ট্রই মানেন নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে কী দেখা গেছে? সংবিধানের ৫ম, ৭ম, ১৩তম ও ১৫তম সংশোধনী মামলা, জেলহত্যা মামলা, মাজদার হোসেন মামলাসহ বহু মামলার রায় একইভাবে এজলাসে ঘোষিত হয়েছে এবং বিচারপতিগণ অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে লিখেছেন। এসব রায় আইনের দ্বারাই কার্যকর হয়েছে তথা এভাবে লেখার বিষয়টি আইনের শক্তিসম্পন্ন। কাজেই এভাবে রায় লেখা প্রথা হিসেবে আইনের আওতাভুক্ত। আইনের শক্তিসম্পন্ন প্রথা হলোÑ একটি অলিখিত আইন যা কোন এলাকায় বা ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহারের মাধ্যমে বা চর্চিত হওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঝ. ঘ. কড়ুধ া. টহরড়হ (অওজ ১৯৬৭ কবৎ ২৫৯) মামলার মাধ্যমে প্রথার এই সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উল্লেখিত সকল মামলার রায় একইভাবে ঘোষিত হওয়ায় এবং ঘোষণাকারী বিচারপতি কর্তৃক এগুলোর পূর্ণাঙ্গ রায় তাঁদের অবসরে যাওয়ার পর লিখিত হওয়ায় সংবিধান মোতাবেকই এসব রায় এভাবে লেখা একটি প্রথা; এই প্রথাই একটি আইন, এ আইন বৈধ, এটি সংবিধানসম্মত। শোনা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিচারপতি এস কে সিনহার প্রশাসনিক বক্তব্যকে ভর করে সুপ্রীমকোর্টে মামলা করবেন। উদ্দেশ্য বর্তমান সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার কাল্পনিক ফানুসে একটু প্রমোদ ভ্রমণ আর কি! কিন্তু তাতে অযথাই নষ্ট হবে তাঁদের সময়, শ্রম ও মেধা। আমাদের প্রত্যাশা পানিটা যেন পরিষ্কার থাকে। লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
×