ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

না’গঞ্জে পাঁচ খুন

মাহফুজের স্বীকারোক্তি টক অব দ্য টাউন

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

মাহফুজের স্বীকারোক্তি টক অব দ্য টাউন

নিজস্ব সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ, ২২ জানুয়ারি ॥ চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ২১ মাস পর মা, মেয়ে ও ছেলেসহ পাঁচ খুনের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জবাসীর খুন আতঙ্ক কাটছেই না। ঘাতক মাহফুজ একাই পাঁচজনকে খুন করে বলে জানিয়েছেন এসপি। সে বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। শুক্রবার দিনভর এটাই ছিল ‘টক অব দ্য টাউন’। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সাত খুনের পর থেমে নেই খুনের ঘটনা। জনপদে এখন দিন-রাত কাটছে খুন আতঙ্কে। চাঞ্চল্যকর পাঁচ খুনের ৫ দিনের মাথায় খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। মাহফুজ পুলিশ ও আদালতের কাছে পাঁচ খুনের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তি দেয়। মাহফুজ একাই শিল (পুঁতা) দিয়ে ও শ্বাসরোধ করে একে একে তাসলিমা, তার ভাই মোরশেদুল, তাসলিমার জা লামিয়া, মেয়ে সুমাইয়া ও ছেলে শান্তকে হত্যা করে বলে আদালতে হত্যাকা-ের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় মাহফুজ। যা বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও শুক্রবার বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় ফলাও করে ছাপা হয়। মাহফুজের হত্যার দায় স্বীকার করার ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জে শুক্রবার পরিণত হয়েছিল ‘টক অব দ্য টাউনে। দোকানপাট, রাস্তাঘাট, আনাচে-কানাচে, বাড়িঘরে এ পাঁচ খুনের দায় স্বীকার করা মাহফুজকে নিয়ে সর্বত্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এর আগে ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের বাড়িতে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শামীমা আক্তার, শ্যালক রানা, গৃহপরিচারিকা মনি ও রেখাকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় শামীমার ভাই মামুন বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। কিন্তু এ মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট শহরের পাইকপাড়া এলাকায় আমেনা মঞ্জিলে ফ্ল্যাটবাসায় মাবিয়া বেগম ও তার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া আক্তারকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় মাবিয়ার ভাই নুরুল হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে ওই বছরের বিভিন্ন সময়ে তিন আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত হিরু মালিক এবং ওমর ফারুক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মিজানুর রহমান তিনজনকে মৃত্যুদ- দেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম লিটন, চন্দন সরকারের প্রাইভেটকার চালক ইব্রাহিম ও স্বপনের প্রাইভেটকার চালক জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করা হয়। ৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম লিটন, চন্দন সরকারের প্রাইভেকটাকার চালক ইব্রাহিম ও স্বপনের প্রাইভেটকার চালক জাহাঙ্গীরের লাশ ও ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার চার সহযোগী হত্যার ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় জামাতা বিজয় পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে মামলার তদন্ত সংস্থা নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে রয়েছেন। এদিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে গত তিন মাসে চার শিশুশিক্ষার্থীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর উপজেলার প্রভাকরদী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সোহাগ (১৪) বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া কালাপাহাড়িয়া গ্রামের বখাটে কামরুলের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গত ১৯ অক্টোবর রাতে খুন হয় পূর্বকান্দি গ্রামের মাদ্রাসাছাত্রী শারমীন (১৬)। ওইদিন রাতে কামরুল দুই সহযোগীসহ শারমীনকে গণধর্ষণের পর শ^াসরোধে হত্যা করে লাশ বাড়ির পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় তিনজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। এদিকে আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের গিরদা গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী হযরত আলীর মেয়ে শিশু শ্রেণীর ছাত্রী হাফছা আক্তার রূপা (৫) গত ২৬ নবেম্বর সকালে স্কুলে গিয়ে আর ফেরেনি। ওইদিন রাতে একই গ্রামের লতিফ মেম্বারের ছেলে ফজলে রাব্বি (১৬) মোবাইল ফোনে রূপার পরিবারের কাছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। রূপার পরিবার বিষয়টি পুলিশকে জানালেও শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি তারা। এদিকে মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে ওই রাতেই অপহরণকারীরা রূপাকে হত্যা করে লাশ তার বাড়ির পাশে ফেলে রেখে যায়। এ ব্যাপারে নিহতের মা লিপি আক্তার বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুজনকে অজ্ঞাতপরিচয় উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন। এছাড়া অপহরণের ছয়দিনের মাথায় উপজেলার ইদবারদী গ্রামের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদের (১১) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এভাবেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের পর হত্যার ঘটনা বেড়েছে বলে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন। নারায়ণগঞ্জে খুন বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম জনকণ্ঠকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের অতীতের চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-গুলোসহ সকল হত্যাকা-ের বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে খুনীরা এত সাহস পেত না। তারা খুন করতে ভয় পেত। এখন খুনীদের হাত লম্বা হয়ে গেছে। তাই একের পর এক খুনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।
×