ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(২২ জানুয়ারির পর) তার মনে হলো তিনি যেভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন রক্তপাত ছাড়া, শাফায়াত তা স্যাবোটাজ করে দিলেন। তার ভাষায়, ’I immediately felt that colonel Shafaat had sabotaged my chance to consolidate my command without a bloodbath. I still wonder why colonel Shafaat had to act the way he did? Was that a guilty feeling or an intentional act to sabotage my effort? If so, who’s cause he was serving?Ó ॥ আট ॥ এরপর শফিউল্লাহ আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ট্যাঙ্কবহর যখন গঠিত হয় তখন সিজিএস-কে দায়িত্ব দেয়া হয় এর প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য বিষয়ে পরিকল্পনা করার। মেজর ফারুককে অস্থায়ীভাবে এর কমান্ডিং অফিসার করা হয়। ফারুক ছিলেন খালেদের দূরসম্পর্কের ভাতিজা। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে অন্যরা ফেরত এলে সিনিয়র হিসেবে মেজর মোমেনকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ফারুক এটি পছন্দ করেননি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি দু’বছরের জ্যেষ্ঠতা চেয়েছিলেন তাও তাকে দেয়া হয়নি। এতে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ফারুককে পাঠানো হয়েছিল আবুধাবি। সেখানে তিনি মৌজে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তাকে ডেকে পাঠানো হয় পাকিস্তানে। তখন তিনি ঠিক করেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। মুক্তিযুদ্ধ করার একটা সময়সীমা ছিল। সে সময়সীমা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে না থাকলে জ্যেষ্ঠতা দেয়া হতো না। ফারুক সে কারণে জ্যেষ্ঠতা পাননি। তিনি অনেক সময় কমান্ডারকে না মেনে সিজিএসের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন, যা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করত। শফিউল্লাহ কয়েকবার খালেদকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। এরপর তিনি ৪৬ ব্রিগেড বা ঢাকা ব্রিগেড নিয়ে আলোচনা করেছেন। ঢাকা রক্ষার জন্যই ছিল মূলত এই ব্রিগেড। সরকারের খুব আস্থাভাজনকে এর কমান্ডার নিযুক্ত করা হতো। তিনি ছিলেন এর প্রথম কমান্ডার। এপ্রিল, ১৯৭২ সালে তিনি সেনাপ্রধান হলে এরপর সিনিয়র ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন। এবং তিনি দক্ষও ছিলেন। তাকেই কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তিনি হঠাৎ হলিডে পত্রিকায় সরকারের বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাকে বলা হয়েছিল ক্ষমা চাইতে। তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করায় চাকরিচ্যুত হন। এরপর যিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন লে. কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, তিনি কমান্ডার হন। মইনুল সোজাসুজি কথা বলতেন। তাকে অনেকেই অপছন্দ করতেন। শফিউল্লাহ কিন্তু এই একজনেরই প্রশংসা করেছেন। মইনুলের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচার শুরু হয় যা বঙ্গবন্ধুর কানেও পৌঁছানো হয়। তিনি তখন মইনুলকে বদলির কথা বলেন। এরপর কমান্ডার খোঁজা শুরু হয়। শাফায়াত জামিল ১৯৭১ সালে খালেদ ও জিয়ার অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। তারা তাকে পছন্দ করতেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শফিউল্লাহকে না জানিয়ে তারাই শাফায়াতকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। শাফায়াত আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে নকশালদের দমনে সফল হয়েছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর নজরেও পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহকে নির্দেশ দিলেন শাফায়াত জামিলকে ৪৬-এর কমান্ডার নিযুক্ত করার। শফিউল্লাহ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু যে বিশ্বাস তার ওপর রেখেছিলেন, শাফায়াতের কর্মকাণ্ডে তা প্রতিফলিত হয়নি। ১৯ আগস্ট শফিউল্লাহ রশীদ ও ফারুককে নির্দেশ দেন বঙ্গভবন থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে। ২২ তারিখ পর্যন্ত তাদের কোনো সাড়া পেলেন না। তখন তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে অনুরোধ করলেন। মোশতাক বললেন, তারা আরো কয়েকদিন থাকবে। মেজর রশীদকে ২২ আগস্ট বঙ্গভবনে পাননি শফিউল্লাহ। পরে জানলেন, জার্মানি থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াবকে আনার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে। ২৪ আগস্ট রেডিওতে শুনলেন, জেনারেল ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খবর শেষ হওয়ার মুহূর্তেই লাল টেলিফোনে ফোন এলো। অপর প্রান্তে মোশতাক। তাকে সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবনে দেখা করতে বললেন। শফিউল্লাহ পৌঁছলেন বঙ্গভবনে। সামরিক সচিব বললেন, প্রথমে তাকে ওসমানীর কাছে যেতে হবে। ওসমানী আগে তার সঙ্গে কথা বলতে চান। বঙ্গভবনে ওসমানীকে একটি অফিস দেয়া হয়েছে। সেখানে যাওয়ার সময় দেখলেন জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খলিল বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরুচ্ছেন। ওসমানীর রুমে ঢুকে দেখেন তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন। শফিউল্লাহ বসার পর বললেন, “এই সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে সেনাপ্রধান হিসেবে তোমার অবদান প্রভূত। শূন্য থেকে ইটের পর ইট বসিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছ। আমি তোমার হাতে ভার অর্পণ করেছিলাম আর তুমি চমৎকার এক বাহিনী গড়ে তুলেছ।” “স্যার, আপনার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। স্যার, আমি শুধু গর্বিত নই, এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমার অংশ হিসেবেও মনে করি।” মনে হলো, ওসমানী একটি বিদায়ী ভাষণ দিচ্ছেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “মুক্তিযুদ্ধে তোমার অবদান স্মরণীয়, মুক্তিযুদ্ধের পরও। এখন বিদেশে তোমার সার্ভিস দেশের জন্য প্রয়োজনীয়। রাষ্ট্রপতি চান তোমার পছন্দ মতো যে কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে যাও।” শফিউল্লাহর জন্য এ সংবাদ ছিল আকস্মিক বজ্রপাতের মতো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন কে?’ ‘জিয়া’, বললেন তিনি। ‘জিয়া, কি তা জানেন?’ ‘হ্যাঁ, তাকে বলা হয়েছে।’ ‘বদলটা কখন হবে।’ ‘আজ, এই মুহূর্ত থেকে এ নির্দেশ কার্যকর হবে।’ ‘খন্দকার মোশতাক আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।’ এ সময় একজন এসে জানাল, মোশতাক শফিউল্লাহর জন্য অপেক্ষা করছেন। ওসমানীও শফিউল্লাহর সঙ্গে মোশতাকের রুমে এলেন। মোশতাক বেশ ভালোভাবেই তাকে সৌজন্য দেখিয়ে পাশে বসালেন। তারপর তিনি ওসমানীর দিকে সাংকেতিক সংকেত দেখালেন যার মানে শফিউল্লাহকে বলা হয়েছে কিনা। ওসমানী মাথা নাড়লেন। মোশতাকও নানা কথা বলে ওসমানীর মতো মূল প্রসঙ্গে এলেন। মোশতাকের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে শফিউল্লাহ জানালেন, তার বিদেশ যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। মোশতাক এ ধরনের উত্তর আশা করেননি। এ উত্তরে তিনি বেশ রূঢ়ভাবে বললেন, “তুমি কি তোমার ও তোমার পরিবারের নিরাপত্তা চাও না? শেখ মুজিব ও তার পরিবারের কী হয়েছে তা তুমি দেখোনি।” তারপর জানালেন শফিউল্লাহ ও তার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি এ প্রস্তাব করেছেন। অন্যদিকে, এ ছিল শফিউল্লাহ ও তার পরিবারের প্রতি হুমকি। শফিউল্লাহ লিখেছেন, তার বয়স তখন ছিল কম, ৪০ও হয়নি। তাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মোশতাককে জানালেন, তিনি আল্লাহ ও ভাগ্যে বিশ্বাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে ও তার পরিবারকে আল্লাহ দেখে রেখেছেন। এখনও তাই করবেন, অন্য কেউ নয়। এই বলে শফিউল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। এবং বেরিয়ে গেলেন। তিনি লিখেছেন, বঙ্গভবন থেকে হতাশ হয়েই ফিরছিলেন। কারণ মোশতাকের চালে তিনি হেরে গেছেন এবং এসব ক্রিমিনালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি পারেননি .left Bangabhaban with regret that I had been out-manoeuvred by Khadaker Moshtaque and I was denied the pleasure of taking action against these criminals.] ॥ নয় ॥ বাসায় ফেরার পথেই শফিউল্লাহ জানতে পারলেন জিয়া ইতোমধ্যে নতুন পদে যোগ দিয়েছেন। এ কারণেই তিনি দ্রুত বঙ্গভবন থেকে ফিরছিলেন। শফিউল্লাহকে সুযোগও দেয়া হলো না সেনাদের বিদায় জানাবার। বাসায় ফিরে জানলেন, সেনাধ্যক্ষের বাসভবন ‘সেনাভবনেই’ আপাতত তিনি থাকবেন এবং বাসা থেকে বেরুতে পারবেন না। সে রাতেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তার বরখাস্তের চিঠি পেলেন। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার ৯ দিনের মাথায় একমাত্র তাকেই বরখাস্ত করা হয়। নতুন অনেককে প্রমোশন দেয়া হয়। যেমনÑ এরশাদ, গোলাম দস্তগীর প্রমুখকে। ২৫ আগস্ট ওসমানী শফিউল্লাহকে ফোন করে সান্ত¡না দিলেন এবং রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করতে বললেন। তিনি বেশ আন্তরিকই ছিলেন। তারপরও শফিউল্লাহ রাজি হননি। ওসমানী বললেন ‘না’ বলার আগে একবার ভেবে দেখতে। এ রকম কিছুদিন চলার পর তিন নবেম্বর চার জাতীয় নেতার হত্যার খবর পাওয়ার পর রাজি হলেন। শফিউল্লাহ রাজি হওয়ার পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি নির্দেশ জারি করে। তার বরখাস্তের নির্দেশ প্রত্যাহার করে তাকে ওএসডি করে তার চাকরি বিদেশ মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় এবং ফরেন সার্ভিসে তাকে আত্তীকরণ করা হয়। এরপর মালয়েশিয়ায় তাকে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়। ৩ জানুয়ারি ১৯৭৬ থেকে ৯ জুলাই ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি দেশের বাইরেই ছিলেন। চলবে...
×