ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

সজল কুমার দত্ত

নতুন ধারার গল্পগ্রন্থ

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

নতুন ধারার গল্পগ্রন্থ

সরকার মাসুদ কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তবে গল্প লেখক হিসেবেও যে তার বিশেষত্ব আছে অর্থাৎ গল্প বলার ভঙ্গিমায় যে তিনি সৃষ্টিশীল মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন একথা সিরিয়াস পাঠক সমাজেও অল্পসংখ্যক লোক জ্ঞাত আছেন। হাসান আজিজুল হকের ভাষায়, আমাদের শিল্প সাহিত্যের চামড়াটা বেশ পুরু, টের পেতে সময় লাগে। এ পর্যন্ত সরকার মাসুদের তিনটি গল্পগ্রন্থ বের হয়েছে। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের নাম ‘আওরাবুনিয়র কাঁটা’। এ বইয়ের অসাধারণ গল্প দুটি হলো ‘অরুন্তুক সময়’ এবং ‘ক্ষুদিরামের যুদ্ধ’। এ গল্পগুলো আমাদের এ কবি গল্পকারের প্রতি মনোযোগী করে তোলে। এ বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ‘বর্ণায়ন’ বের করেছে তার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘অপমানের দিন’। বইটি পড়া শেষে পাঠক যে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসবেন এমনটি নয়, তবে লেখকের ভাষা ব্যবহারের পারঙ্গমতায়, বর্ণনায় মুগ্ধ হবেন এবং কাহিনীনির্ভর গল্পের বিপরীত নতুন ধারার গল্প পাঠের রস আস্বাদনে বঞ্চিত হবেন না। ‘অপমানের দিন’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ভেতরে বাইরে’। এটি একটি গ্রাম্য রেস্টুরেন্টের গল্প। রেস্টুরেন্টে বসে থাকা একজন ভদ্রলোকের পর্যবেক্ষণ, নির্বাচন-প্রচারণা, সাধারণ মানুষের কথাবার্তা, বিশ্বাস লেখক দক্ষতার সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী করেছেন। রেস্টুরেন্টে বসে সময়ের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। লেখকের ভাষায়, পিছনে ভরা খাল বয়ে যাচ্ছে। পিছনের বেঞ্চে জানালা বরাবর বসলে কান পাততে হয় না, এমনিতেই শোনা যায় ওই প্রবহমান সময়ের মর্মধ্বনি কুল-কুল..কুল-কুল...কুল-কুল...। রেস্টুরেন্টে চা বানায় যে লোকটা তার নাম আক্কাস গোরাপি। তার মাথার ওপর পেরেকে ঝুলছে পচা রক্তের মতো কালচে লাল জামা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সতীর্থ বন্ধুর গল্প ‘একদিন সুব্রত।’ সুব্রত রাজশাহী শহরের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্র। তবে ‘সুব্রত কেবল রাজ্যের বই পুস্তকে ডুবে থাকে না, কবিতাও লেখে।’ গল্পে পদ্মা নদীর কিঞ্চিত অথচ চুম্বক বর্ণনা আছে। ‘এখন বসন্তের মাঝামাঝি।... পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। সামনের দিকে বেশ খানিকটা জায়গা সি-বিচের মতো। দেখতে দারুণ লাগে। মাঝে মধ্যে পাল তোলা নৌকা চলে যায়। ওপারে চরের পায়ে হাঁটা পথ ধরে লাইন হয়ে মানুষ আসে। আবার দূরে চলে গেলে মানুষের অবয়ব ক্রমে বিন্দুতে পরিণত হয়। সুব্রত এ দৃশ্য অনেকটা সময় ধরে দ্যাখে।’ গল্পের ছোট্ট আয়নায় পাঠক সুব্রত, তার বাবা দাদু-পিসি এবং তাদের বাড়ির ভিতরটা দেখতে পাবেন।’ বইটির নাম গল্প ‘অপমানের দিন’ ঢাকা শহরে কপর্দকশূন্য দুই লেখক বন্ধুর একদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এ গল্পে বর্ণিত হয়েছে। বিপদের দিনে বন্ধু কেনা যায়- এ গল্পে তা আবার সত্য হয়ে ওঠে। বন্ধুর ব্যবহারে মুজিব একবার নিচুস্বরে ছি বলল। দ্বিতীয়বার জোরে উচ্চারণ করল ছি! এই সজোরে ছি এর সঙ্গে এক ফুসফুস ঘৃণা বেরিয়ে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল বাতাসে। পেটে দাউ দাউ ক্ষুধা নিয়ে বন্ধুর সাহায্যের প্রতীক্ষা বর্ণিত হয়েছে এভাবে- তবু অপেক্ষা করি, কেননা... ক্ষুধার ক্লান্তিতে অপমানে বিকারে আমরা মাটির ভেতর সেঁধিয়ে যেতে থাকি। দোকানপাট, যানবাহনের সারি, আশপাশের ভবনসমূহ সব কিছু এ মুহূর্তে ধোঁয়া ধোঁয়া। সবকিছু অতি ভঙ্গুর, যেন টোকা দিলেই খসে পড়বে সিগারেটের লম্বা ছাই। সবদিক বিচার করলে এ বইয়ের শ্রেষ্ঠ গল্প ‘আলেয়ার কথা’। শুধুই বইয়ের কথাই বলি কেন, আধুনিক বহু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পের বিচারক নিক্তিতে ওঠার দাবি রাখে এ গল্পটিকে। ‘আলেয়ার কথা’ গ্রামের এক দুঃখী নারীর জীবনগাথা। কাহিনীটি পুরনো। কিন্তু লেখক গল্প বর্ণনায় চরিত্র, নির্মাণে আধুনিক সৃষ্টিশীল মেধার পরিচয় দিয়েছেন। পুরনো কাহিনীই তিনি আধুনিক মননের কাছে নতুনভাবে, নতুন টেকনিকে হাজির করেছেন। নিটোল গল্প পাঠের ক্ষুধা নিয়েই অধিকাংশ পাঠক গল্প পড়েন। কিন্তু বাস্তব জীবন কি সব সময়ই নিটোল গল্প তৈরি করে? এ সব গল্পে সেই বাস্তব জীবনকে সাহিত্যের ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। নতুন গল্পের স্বাদ যারা পেতে চান তারা সরকার মাসুদের গল্পগুলো পড়তে পারেন। তবে পাঠককে মনোনিবেশের সংকল্প নিয়ে পড়তে হবে। একটু ভাবলেই বোঝা যায়, যা আমাদের মনোযোগ দাবি করে না, তার কোন মূল্যই থাকতে পারে না।
×