ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

নারীবাদ

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

নারীবাদ

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আমাদের কলেজের মেয়েরা সবাই যখন একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে জামা বানাচ্ছে, তখন আমি প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি বসে থাকি গণজাগরণ মঞ্চে। ক্লাসের মেয়েরা আমাকে দেখে কেউ কেউ নাক সিটকায় আর বলে- ‘আমি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছি’, কেউ বলে- ‘জামায়াত-শিবির নামের আপদ নিজের ঘাড়ে টেনে আনছি’, আবার কেউ বলে- ‘হায় হায়! সারাদিন গণজাগরণ মঞ্চে থেকে তো তোমার স্কিন পুরাই কয়লা হয়ে যাচ্ছে!’ শুধু দুইটা মেয়ে ছিল যাদের একজনের নাম মিতি আরেকজনের নাম স্নিগ্ধা, এরা দুজন আমাকে দারুণ উৎসাহ দিয়েছে! নিজেরা যেয়ে সেখানে বসে থেকেছে, একটা হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে- ‘তোর ভয় নাই, আর কেউ না হোক, আমরা তোর পাশে আছি!’ মিতির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি। রাজশাহীর আলুপট্টির মোড়ে জড়ো হওয়া সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে গলা ফাটিয়েছি- ‘ক’তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার...’ সে এক অদ্ভুত সময়! যেন একাত্তরের বাইরে আরেক একাত্তর! তার কিছুদিন আগে, রাজশাহী জেলাপ্রশাসনে নারীদের একটা সেমিনার ছিল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম আমি যেখানে ‘ইভটিজিং’ নিয়ে আর ‘নারীদের আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ’ নিয়ে কথা বললাম বড় বড় নারী নেত্রীদের একজন সেখানে নারীর অধিকার নিয়ে বললেন যে, নারীদের জন্য আলাদা কবরস্থান লাগবে! আমি বিস্মিত তার জ্ঞান দেখে। নারীদের দুরবস্থার একটি কারণ এ রকম অজ্ঞ কয়েকজনও বটে। এদেশে নারী নিজেই একটা গালি হয়ে জন্ম নেয়। সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠান হবে মহাধুমধামে, অথচ কোন মেয়ে পিরিয়ডের জন্য প্যাড কিনতে গেলেই সেই দোকানের আশপাশ থেকে শোনা যাবে বিশ্রী মন্তব্য। অথচ এই পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব না হলে পুরুষদের জন্ম কোত্থেকে হতো? বড় কোন পুরস্কার পেলে অন্যেরা বলবে- সাবাস! বাপ কা বেটি! নারী স্বাধীনতা নিয়ে কিছু লিখলে প্রতিক্রিয়া বলতে শেষে ওই পুরুষদেরই মন্তব্য আমাকে শুনতে হয়। সংখ্যালঘু নারীদের প্রতিক্রিয়া কোন ক্রিয়া আদৌ তৈরি করে বলে আমার মনে হয় না। যেন কোন নারী সবল মন্তব্য করলে তার সংসার ভেঙে খানখান হয়ে যাবে! যে দেশে অন্য কিছু না শুধুমাত্র ফেসবুক স্ট্যাটসের এই অবস্থা সেই দেশে নারীদের স্বাধীনতার চেয়ে ‘স্বাধীনতা কি?’ সেই বোধ কতটা জরুরী তা নাই-বা বললাম! শুধু বলি- নৌকা তীরে ভেড়াতে অনেক সময় স্রোতের বিপরীতেই যেতে হয়! আমি না হয় তাই-ই গেলাম... শেকল পরে থাকতে থাকতে শেকলবিহীন পৃথিবীটাকে আমি কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেব না, যত যা-ই হোক না কেন! অনেক নারীকে শেকল ভেঙে বেরুতে দেখে অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করে। দাসীবাঁদি রূপে নারীদের রূপ যেন এক জড়তা, গাঢ় অন্ধকার। সেই জড়তা ভাঙার পণ যাদের মাঝে দেখি তাদেরই ভাললাগে। নারীবাদ হলো সমতা, মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি। স্নো-পাউডারের বিজ্ঞাপনে বেশিরভাগ শরীর প্রদর্শন ব্যবসায়িক ফায়দা মাত্র, এতে নারী স্বাধীনতার কতটা যোগ আছে তারাই বলতে পারবে। এর সঙ্গে নারীবাদের যোগসূত্র আমি পাইনি। আজ থেকে অনেককাল আগে বেগম রোকেয়া ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ আর ‘অবরোধবাসিনী’ শীর্ষক লেখাগুলোতে যে স্বাধীনতার কথা বলে গিয়েছেন সেটা হলো সমতা, যোগ্যতাবলে অর্জন করা সমতা। বাংলাদেশের অনেক এলাকাতে একাত্তর সালের বীরাঙ্গনাদের ‘পাঞ্জাবীর বউ’ বলা হয় জেনে একবার আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। যেখানে সেই মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নারীদের পাশে পুরো দেশ দাঁড়াবে সেখানে সমাজের একি রূপ? এটা কি তাহলে অসভ্য সমাজ নয়? একটা সময় আমার কেটেছে ধোঁয়াশায়। ক্লাস সিক্সের মাঝামাঝি। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি দুই পায়ের মাঝখান ভিজে গেছে তাজা খুনে। রক্তাক্ত প্রান্তর! নির্ঘাত আমার বড় কোন অসুখ হয়েছে! আমার বড়বোন বাথরুমে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিলো, ছোটবেলার পুতুলের বালিশের মতন একটা জিনিস কয়েকদিন করে প্রতি মাসে পরতে হবে, সেসময় দৌড়ঝাঁপ করা যাবে না। পুতুলের বালিশের মতন জিনিসটার নাম স্যানিটারি ন্যাপকিন। ভিজে যাওয়ার পর সেটা বদলে ফেলতে হবে। সবশেষে যোগ করল- কাউকে বলা যাবে না। আমাদের ক্লাসের মেয়েদের মাঝে তখনও চেনাজানা কারও হয়নি এটা। আমি ভাবলাম- এরচেয়ে গহীন বনে পালিয়ে যাওয়া ভাল! পরে বুঝলাম- বইয়ে যে ঋতুস্রাবের কথা পড়েছি এটা হচ্ছে সেটা। পিরিয়ডের কথা বলাটা এ সমাজে অশোভন, কিন্তু সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠান করাটা শোভন! এদেশের মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়েরা খুব ছোটবেলা থেকে যে জিনিসটা ঠিকমতো শিখে যায় সেটা হলো- কম্প্রোমাইজ আর অভিনয়। এদের বাথরুম থেকে শুরু“করে পরিধেয় পোশাক সবই কম্প্রোমাইজের সূতিকাগার। পেস্টের গলা টিপে টিপে আরও দুটো দিন বেশি চালিয়ে নিতে হবে, স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে মেরামতের অযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত কাটা মেরে বা সেলাই করে ব্যবহার করতে হবে, বাথরুমে শ্যাম্পু ফুরিয়ে গেলে মাস শেষে কেনা যাবে না বলে পানি ভরতে হবে, নিজেদের দৈন্য দশা গোপন করতে মহাযতেœ তুলে রাখা কাপ-পিরিচে চা ঢেলে মেহমানকে খাওয়াতে হবে, প্রাইভেট টিচারকে মাসের পাওনা দিতে দেরি হলে সময়মতো বেতন না পাওয়ার অজুহাত দিতে হবে... ইত্যাদি। আমার মায়ের কাছে শুনেছি সিরাজগঞ্জের তিন নান্দিনা নামের প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে তিনি ঢেঁকিতে পার দিয়েছেন, গোবর ফেলেছেন। হেন কাজ নেই যা তিনি করেননি। স্বাধীনচেতা সত্তার জন্য ‘মাগী মানুষ’ গালিটি বহুবার শুনেছেন। তবুও তিনি শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাই তাঁর বড় মেয়ে জন্মের পর তাঁর নাড়ির অংশটি আমার ভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট চাচার হাতে ম্যাচবক্সে ভরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল- তঁাঁর মেয়ে ভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট হবে, সমাজে তার কথার দাম থাকবে... আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমার স্বপ্ন দেখা মায়ের স্বপ্নটা সেভাবেই পূরণ হয়েছে, তাঁর বড় মেয়ে সুলতানা রাজিয়া এখন প্রাণরসায়নবিদ। অথচ আমার বোন ছোটোবেলায় জন্মের পর চুপচাপ স্বভাবের হওয়ার কারণে আমার মাকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কারণ আমাদের বংশের কোন এককালে এক পাগল ফুফু ছিলেন। তাঁর নাম ছিল ‘হালিমা’। তিনিও ছিলেন চুপচাপ স্বভাবের। আপুকে ছোটবেলায় প্রায়ই শুনতে হয়েছে- সে হালিমা পাগলের মতন! ভাগ্যিস আমি যখন জন্মেছি ততদিনে আমার মা-বাবা শহরে এসেছিলেন। নইলে আমাকে হয়ত ‘দ্বিতীয় হালিমা পাগল’ খেতাব পেতে হতো! সম্ভবত আমি হবো তাঁদের শেষ গ্র্যাজুয়েট সন্তান। একহালি গ্র্যাজুয়েট সন্তানের জননী হওয়াটা বোধহয় খুব আনন্দের, তাই না? আমি তাঁর মুখে সেই আনন্দের হাসি দেখি রোজ... বিনে পয়সায়! পরক্ষণেই ভাবি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের বলা, ‘মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়’- কথাটা তাহলে মিথ্যে নয়!
×