ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মরার আগ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অটল থাকার ঘোষণা এরশাদের

জাপায় চলছে নানা খেলা, নতুন মহাসচিব হাওলাদার

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

জাপায় চলছে নানা  খেলা, নতুন  মহাসচিব হাওলাদার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ চর দখলের মতো দল দখলের লড়াই চলছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে। পক্ষ দুটি। একটি এরশাদের নেতৃত্বাধীন। অপরটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রওশন। সঙ্গে আছেন তার অনুসারীরা। তবে মাঠের সমর্থন এরশাদের দিকেই। তার সঙ্গে আছেন ভাই জিএম কাদের। বরিবার দলের ভবিষ্যত উত্তরসূরি হিসেবে কো-চেয়ারম্যান পদে কাদেরের নাম ঘোষণা করেছিলেন এরশাদ নিজেই। এ থেকেই জটিলতার শুরু। এমন সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ রওশন। পাল্টা জবাবের প্রস্তুতি নেন তিনি। প্রচ- ক্ষিপ্ত হন এরশাদের ওপর। সোমবার বিরোধী দলের নেতা অনুসারীদের নিয়ে দিনভর বৈঠক করেন। রাতে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু রওশনকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এতে ফের ক্ষিপ্ত হন এরশাদ। রাতেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে এরশাদ বলেন, রওশনের নেতৃত্বে বৈঠক অবৈধ। সকালে বিমানযোগে রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। মঙ্গলবার দুপুরে জরুরী সংবাদ সম্মেলন ডেকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দায়িত্বে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে মহাসচিবের পদ থেকে বাবলুকে অব্যাহতি দেন। নতুন মহাসচিব হিসেবে রুহুল আমিন হাওলাদারের নাম ঘোষণা করেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে পরই জাপায় ফের নতুন মেরুকরণ শুরু হলো। বিকেলে রওশনের নেতৃত্বে সংসদীয় দলের বৈঠকে অংশ নেন এরশাদ। সেখানে অনেকটা তোপের মুখে ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ। তার সকল সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বৈঠকে। জবাবে এরশাদ বলেছেন, মরার আগ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বাবলুকে স্বপদে ফেরাতে এরশাদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন রওশনপন্থীরা। দলের নির্বাচিত এমপিদের বেশিরভাগই রওশনের অনুসারী। তাই সংসদীয় দলের বৈঠকে এরশাদকে রীতিমতো তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। তবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন। শুরু থেকেই তিনি দলের চেয়ারম্যান। নানা সময় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধে দল ভেঙ্গেছে। ইতোমধ্যে পাঁচ ধারায় টুকরো টুকরো দলটি। এর মধ্যে চারটি দলই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত। তবে মূলধারা হিসেবে এরশাদকেই মানুষ চেনে। মহাসচিবের পদ থেকে বাবলুকে অব্যাহতি ॥ এইচ এম এরশাদের ঘোষণার প্রেক্ষিতে পাল্টা রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন ঘোষণা করে দলের মহাসচিবের পদ খুইয়েছেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তার জায়গায় ফিরেছেন চেয়ারম্যানের দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। দলে ভাঙনের গুঞ্জনের মধ্যে মঙ্গলবার বনানীতে এক জরুরী সংবাদ সম্মেলনে ভাই জিএম কাদেরকে পাশে নিয়ে এ ঘোষণা দেন এরশাদ। অন্যপাশে ছিলেন হাওলাদার। এরশাদ বলেন, নেতাকর্মীদের সম্মতিতে পরবর্তীতে দলের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত করার জন্যই জিএম কাদেরকে কো- চেয়ারম্যান করা হয়েছে। দলীয় গঠনতন্ত্রে ওই পদ না থাকলেও আগামী সম্মেলনে বিষয়টির সুরাহা করে ফেলা হবে। বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘোষণা দিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, দলের কাউন্সিল আয়োজনে বাবলু ব্যর্থ হয়েছেন। একটি প্রেসিডিয়ামের বৈঠক করতে পারেনি। সব জেলা সম্মেলনে আমাকে যেতে হয়েছে। তিনি নিজে থেকে কিছু করতে পারেনি। তাই বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে দলের স্বার্থে। এরপর দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিবের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন এরশাদ। তিনি বলেন, হাওলাদার আমার মহাসচিব ছিলেন ১৪ বছর। বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন এরশাদ। হাওলাদারও সেই পক্ষ নেন। অন্যদিকে রওশনের নেতৃত্বে পার্টির আরেকটি অংশ নির্বাচনে থাকার পক্ষে অবস্থান নেয়। বাবলু ছিলেন সেই পক্ষে। বর্জন করেও আইনের মারপ্যাঁচে সেই ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন এরশাদ; পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ। আর বিএনপির বর্জনে রওশন হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা। ভোট নিয়ে সেই মতোদ্বন্দ্বের জেরে ২০১৪ সালের এপ্রিলে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় হাওলাদারকে। নতুন মহাসচিব হন রওশন ঘনিষ্ঠ বাবলু। জাতীয় পার্টির নেতাদের সরকারে থাকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই এরশাদ বলেছিলেন, রওশনই তার কা-ারী। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, দুজন নেতা আমার এবং আমার স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আমাদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই, থাকতে পারে না। আগের রাতে সভাপতিম-লীর কথিত যে বৈঠক থেকে রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছেÑ সেই সভা রওশন ডাকেননি বলেও দাবি করেন এরশাদ। সেখানে যারা উপস্থিতি ছিলেন, অনেকেই বৈঠকের কথা জানতেন না। মিথ্যা টেলিফোন করে তাদের সেখানে ডাকা হয়। অনেকে দেখতে গিয়েছিলেন বৈঠকের নামে কি হয়। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রেসিডিয়াম সদস্য। চেয়ারম্যান হিসেবে প্রেসিডিয়াম মিটিং ডাকার এখতিয়ার একমাত্র আমার। আমি এখনও চেয়ারম্যান আছি। ভবিষ্যতেও থাকবো। সিদ্ধান্ত কেবল আমিই দিতে পারি। এরশাদ বলেন, পার্টির দিকটি তিনিই দেখেন; রওশন দেখেন ‘পার্লামেন্টারি বডি’। এরশাদ বলেন, আমাদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নাই, ছিলও না। গতকাল যা হয়েছে তা প্রেসিডিয়াম মিটিং ছিল না। রওশন কোন মিটিং ডাকেনি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেনÑ রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার যে ঘোষণা এসেছে, ‘তা দেয়ার বাবলু কে?’ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত থাকতে চান না জানিয়ে এরশাদ বলেন, এ পদ থেকে পদত্যাগের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করবো। এ পদে আর থাকতে চাই না। সংগঠনের জন্য সারাদেশ ঘুরে বেড়াতে চাই ও কাজ করতে চাই। তিনি আরও বলেন, দলের গঠনতন্ত্রে না থাকলেও আগে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আহসান হাবিব লিঙ্কন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে অতিরিক্ত মহাসচিব করেছিলাম। তখনতো কোন প্রশ্ন ওঠেনি। গঠনতন্ত্রের বাইরে জিএম কাদেরকে কো- চেয়ারম্যান করেছি। আমি যতটুকু বলবো, তিনি শুধু ততটুকু দায়িত্বই পালন করবেন। আগামী এপ্রিল মাসেই কাউন্সিল হবে। তখন গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে নেয়া হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ায় দলে বিভক্তি হবে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে এরশাদ বলেন, অসম্ভব। তাদের সঙ্গে দশজন লোকও নেই। এ সময় উপস্থিত নেতাকর্মীরা সমস্বরে উল্লাস প্রকাশ করেন। সংবাদ সম্মেলনে দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাসহ বিপুলসংখ্যক কর্মী সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। রওশনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবেন কিনা এমন প্রশ্নে এরশাদ বলেন, তারা কোন অন্যায় করেননি। অবশ্য ভাঙনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, ‘অসম্ভব’, জাতীয় পার্টি ‘বিভাজিত হবে না’। দেয়ার ইজ নো সঙ্কট ইন জাতীয় পার্টি। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ কোন সঙ্কট নেই। নো ওয়ান কুড ব্রেক ইট, জোর গলায় বলেন এরশাদ। এরশাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান সংসদীয় দলের ॥ জাতীয় পার্টিতে নতুন কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ ও মহাসচিব পরিবর্তনের যে সিদ্ধান্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যানের কথা জানিয়েছে পার্টির সংসদীয় দল। জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশন সামনে রেখে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকের পর বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যা হয়েছে, চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলের প্রতিটি সদস্য তার বিরোধিতা করেছেন। আমরা তা মেনে নিতে পারিনি। প্রেসিডিয়াম ও সংসদীয় দলের বৈঠকে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। চেয়ারম্যানও বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মহাসচিবের পদ হারানো জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নুসহ রওশন এরশাদপন্থী কয়েকজন সাংসদ এ সময় তাজুলের পাশে ছিলেন। শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পাল্টাপাল্টি ঘোষণার মধ্যেই বিরোধী দলীয় নেতা রওশনের সভাপতিত্বে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের এ বৈঠক হয়। যাতে এরশাদও উপস্থিত ছিলেন। রুহুল আমিন হাওলাদারসহ জাতীয় পার্টির ৪০ সংসদ সদস্যের সবাই ছিলেন বৈঠকে। সন্ধ্যায় সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে এরশাদ যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন এ সময় তার পাশে ছিলেন বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, এর আগে তিনি সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের কথা বলেননি। স্যার ও ম্যাডাম (রওশন এরশাদ) পরবর্তীতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাছাড়া দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তে অনেকেই একমত। তিনি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। সবাই তা মেনে নিয়েছেন। সব সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দলের মহাসচিব থাকবেন হাওলাদার। কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জিএম কাদের। অবশ্য এক ঘণ্টা আগে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, স্যারের সকল সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বৈঠকে সবাই স্যারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের এ অবস্থানের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত এইচ এম এরশাদও নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছেন। দলের চেয়ারম্যান বলেছেন, জাপা ও সংসদীয় দল আলোচনা করে মহাসচিব বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে। এরশাদ বেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী হয় জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি দলের বৈঠক। বৈঠকে এরশাদের সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি আরও জানিয়েছেন, পার্লামেন্টারি বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনের জন্য সংসদীয় দলের নেতা রওশন এরশাদকে যৌথসভা ডাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং সেখানে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানালে তিনি সায় দিয়েছেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সংসদীয় দলের বৈঠকে রওশন বাবলুর কাছে জানতে চান একক সিদ্ধান্তে তিনি কেন তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ঘোষণা দিলেন। জবাবে বাবলু বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ ছাড়া কোন পথ ছিল না। তাছাড়া এ নিয়ে সমর্থন জানিয়েছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এরপর রওশন দলের চেয়ারম্যানকে বলেন, মহাসচিব পরিবর্তনে আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক। অন্য বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে স্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যান এরশাদ। তবে রওশনপন্থী এমপিদের অনেকেই বৈঠকে এরশাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন বলে জানা গেছে।
×