ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত;###;৫ শতাংশকে ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর করার প্রস্তাব ;###;অধ্যাপকদের ২৫ শতাংশকে গ্রেড-১ করার দাবি

ক্লাসে ফিরছেন শিক্ষকরা ॥ প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

ক্লাসে ফিরছেন শিক্ষকরা ॥ প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দাবি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসেই আজ থেকে ক্লাসে যাচ্ছেন টানা নয় দিন ধরে কর্মবিরতিতে থাকা ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ফলে আজ থেকে আবার পুরোপুুরি সচল হচ্ছে ক্যাম্পাস। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একদিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈঠক করে আন্দোলনরত শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন নেতৃবৃন্দ ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, আন্দোলন প্রত্যাহার নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখে আমরা আন্দোলন স্থগিত করছি। ৩ ফেব্রয়ারি আন্দোলন পর্যালোচনা কমিটির মিটিং আছে। ওই মিটিংয়ে দাবি বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখে আন্দোলনের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ফেডারেশনের বৈঠক শেষে শিক্ষকরা বলেছেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে ক্লাসে ফিরে যাচ্ছি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, আন্দোলন প্রত্যাহার নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখে আমরা আন্দোলন স্থগিত করছি। কর্মবিরতি ও আন্দোলন স্থগিত করে ফের ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তিনি বলেন, দাবি পূরণে আমরা আমাদের কর্মসূচী স্থগিত করেছি। এর অর্থ কর্মসূচী প্রত্যাহার নয়। কেননা কর্মসূচী স্থগিত করা আন্দোলনেরই অংশ। যদি আমাদের দাবি খ-িতভাবে বাস্তবায়ন করা হয় কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে যদি দাবি বাস্তবায়নে বিলম্ব করা হয় তাহলে তা মেনে নেয়া হবে না। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ফেডারেশনের পর্যালোচনা সভায় পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ ছাড়া দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতি নিজেদের স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কোন প্রেক্ষিতে কর্মসূচী স্থাগিত করা হয়েছে তা অবহিত করবেন বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। বিকেল সোয়া ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে শুরু হয়ে বৈঠক চলে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষক ফেডারেশনের নেতারা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় গণভবনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরই শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার বৈঠক করে আন্দোলনের অবস্থান সম্পর্কে শিক্ষকদের অবস্থান জানানো হবে। একই সময়েই আন্দোলনরত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল অনেকটা নমনীয় অবস্থান প্রকাশ করে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা তাদের দাবিগুলো তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে খুব ইতিবাচক মনে হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি শিক্ষকদের দাবিগুলো বিষয়ে দেখবেন। এ জন্য তিনি শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দাবি পূরণ না হলেও প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর ভর করেই ক্লাসে যাচ্ছেন বলে সোমবার রাতেই জানিয়েছিলেন ফেডারেশনের অনেক নেতা। এরপর মঙ্গলবার দিনভর সকলের নজর ছিল শিক্ষকদের দিকে। ফেডারেশন বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত নেয় তা জানান জন্য উদগ্রীব ছিল সকলেই। অবশ্য বৈঠকের আগেই ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন শিক্ষক নেতারা। বৈঠকে আন্দোলন স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে জানিয়ে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস তাদের কাছে প্রজ্ঞাপনের চেয়েও ‘বেশি কিছু’। ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফদির উদ্দিন আহমেদ বলেন, আজও (মঙ্গলবার) কর্মবিরতি চলছে। বিকেল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সঙ্গে শিক্ষকদের আলোচনা এবং ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মবিরতি তুলে নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিগুলোর মোর্চা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ১১ জানুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মবিরতিতে গেলে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়ে। এই সঙ্কট কাটাতে শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনরত শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে দাওয়াত পান সোমবার। অষ্টম বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেলে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি অধ্যাপক পদের ‘অবনমন’ ঘটেছে বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। একই অভিযোগে আন্দোলন করছেন দেশের ৩১০টি সরকারী কলেজে কর্মরত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ হাজার সদস্যও। তবে মর্যাদা ও বেতন প্রশ্নে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৯ মাস ধরে আন্দোলনের পর গত ১১ জানুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মবিরতি পালন করে আসছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সঙ্কট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে আলোচনার ধারাবাহিকতায় গত রবিবার সন্ধ্যায় শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইনের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। যেখানে বলা হয়েছে, সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট অধ্যাপকের মধ্য থেকে ৫ শতাংশকে ডিস্টিংগুইশড (বিশিষ্ট) অধ্যাপক করতে হবে। এই পদের মূল বেতন হবে জ্যেষ্ঠ সচিবের সমান। একই সঙ্গে আগের মতো মোট অধ্যাপকদের মধ্য থেকে ২৫ শতাংশকে গ্রেড-১ করারও প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। এর আগে গত দুই এক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের জন্য আবেদনের কথা জানিয়েছিলেন। তবে আবেদন করেও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সময় না পাওয়ায় হতাশাও ব্যক্ত করেন তারা। বলেন, শিক্ষকদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুললেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পাঁচ মিনিট বসতে পারলে এই সঙ্কটের সুরাহা বলে তারা মনে করেন। তবে গত আট মাসে কয়েক দফা চিঠি পাঠিয়ে কোন সাড়া পাননি বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন শিক্ষকরা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো চিঠি ‘আমলাদের বলয় ভেঙ্গে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যায়নি বলেও অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। তারা অভিযোগ করেন, একটি মহল প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষকদের বক্তব্যগুলো খ-িতভাবে উপস্থাপন করেছে। আমরা মাত্র পাঁচ মিনিট সময় পেলেও তাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে পারতাম। ঠিক এমন অবস্থায় কর্মবিরতির অষ্টম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটাতে শিক্ষক সমিতির নেতাদের ডাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্লাসে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে শিক্ষকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চান ছাত্রছাত্রীদের যাতে ক্ষতি না হয়, তেমনিভাবে শিক্ষকরাও যে দাবিগুলো করেছেন তারও সুষ্ঠু সমাধান হোক। এ কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন তারা। গত ১১ জানুয়ারি থেকে পে স্কেলে মর্যাদাহানির প্রতিবাদ ও বৈষম্য নিরসনের দাবিতে শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে রীতিমতো অচল ছিল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাদে দেশের ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে চলা কর্মসূচীর প্রথম দিন সেমিস্টার/কোর্স ফাইনাল ছাড়া কোন ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বন্ধ ছিল সান্ধ্যকালীন কোর্সও। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ও কোর্স ফাইনাল পরীক্ষাও বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা অধিকাংশই প্রশাসনিক কোন দায়িত্বও পালন করেননি। শিক্ষকদের এ লাগাতার কর্মবিরতিতে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। ঢাকাসহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য ভর্তি হওয়া অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাসও পড়েছিল অনিশ্চিয়তায়। কর্মসূচী দীর্ঘস্থায়ী হলে উচ্চ শিক্ষায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা ছিল শিক্ষার্থীদের। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়লে সে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়ী থাকবেন এ কথা বলে আসছিলেন শিক্ষকরা। তারা সব সময়ই বলেছেন, শিক্ষার্থীদের যাতে ক্ষতি না হয় সে জন্য মাসের পর মাস আমরা নরম ও অহিংস কর্মসূচী পালন করেছি। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে এখন ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কর্মসূচীর কারণে যদি দীর্ঘমেয়াদে সেশনজট হয় তাহলে আমাদের (শিক্ষকদের) করার কিছু থাকবে না। কারণ আমরা সরকারকে অনেক সময় দিয়েই কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়েছি। বেতন কাঠামোয় ‘অসঙ্গতি’ নিরসনে শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও আমলারা বাধা বলে মনে করেন আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, আমাদের নয় মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আমলারা ইচ্ছা করেই এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ওরা ভাবছে ওরা কুলীন লোক, ওদের পর্যায়ে কাউকে দেয়া যাবে না।’ যারা এসব করছেন প্রধানমন্ত্রীকে তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন শিক্ষকরা।
×