ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এসআই মাসুদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে হাইকোর্টের রুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

এসআই মাসুদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে হাইকোর্টের রুল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পুলিশের মধ্যে যারা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন নিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভাগের পরিচ্ছন্নতার বিভাগের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসের পুলিশের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনের ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ শিকদারের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে এই বিষয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ব্যাংক ও ডিএসসিসি কর্মকর্তার পুলিশী নির্যাতনের ঘটনায় বলেছেন, এসআই মাসুদ শিকদারের আচরণ পুলিশসুলভ ছিল না এবং পুলিশ আর সাদা পোশাকে ডিউটি করতে পারবে না। সেবামূলক অবস্থান থেকে পুলিশের বিচ্যুতি বিব্রত করে বলেছেন সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি। এর আগে পুলিশের বেপরোয়া আচরণের বিষয়ে কোন ব্যক্তির অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠান (ডিপার্টমেন্ট) গ্রহণ করবে না বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে পুলিশী নির্যাতনের ঘটনায় তার লিখিত অভিযোগের মামলা (এফআইআর) গ্রহণ করতে মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গোলাম রাব্বীকে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন কেন অসাংবিধানিক হবে নাÑ তাও জানতে চেয়েছে আদালত। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের বেঞ্চে সোমবার এই নির্দেশ ও রুল জারি করেন। সুপ্রীমকোর্টের দুই আইনজীবী ও এক গণমাধ্যমকর্মীর করা একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে এই নির্দেশ ও রুল জারি করেন আদালত। তেজগাঁও পুলিশের উপকমিশনারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন গোলাম রাব্বী। সেই লিখিত অভিযোগ এজাহার হিসেবে গণ্য করতেই আদালত নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশী নির্যাতন নিয়ে আদালত যে রুল দিয়েছে তা দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, তেজগাঁও পুলিশের উপকমিশনার, মোহাম্মদপুর থানার ওসি এবং এসআই মাসুদ শিকদারকে তার জবাব দিতে বলা হয়েছে। রিটের তিন আবেদনকারী ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান, এস এম জুলফিকার আলী এবং রেডিও ধ্বনির নিউজ ব্রডকাস্টার জাহিদ হাসান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে আদালতে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়। রিট আবেদনে নির্যাতনের ঘটনার বিচার বিভগীয় তদন্ত এবং তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ চাওয়া হয়। কিন্তু আদালত সেই নির্দেশ দেয়নি। ব্যাংক কর্মকর্তা নির্যাতনের জন্য এসআই মাসুদ শিকদারকে গ্রেফতারের কোন নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। গত ৯ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে আটক করে ইয়াবা ব্যবসায়ী-সেবনকারী বানানোর ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ শিকদারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এরপর রাত ৩টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরিয়ে তাঁকে মারধর করেন। এমনকি তাঁকে বেড়িবাঁধে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকিও দেন বলে অভিযোগ করেছেন গোলাম রাব্বী। সে সময় রাব্বীকে মারধরও করা হয়। ডান হাতের কনুই ও বাঁ পায়ে ক্ষত নিয়ে তিনি এখনও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পুলিশ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে মাসুদ শিকদারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। ঘটনার পরদিন রবিবার সকালে এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করেন রাব্বী। এরপর সারাদেশে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আলোচনায় আসে বিষয়টি। গত ১১ জানুয়ারি সকালে এসআই মাসুদকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনার তদন্তে একটি কমিটিও কাজ করছে। সাদা পোশাকে পুলিশ ডিউটি করতে পারবে না ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনের ঘটনায় বরখাস্ত হওয়া মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারের আচরণ ‘পুলিশসুলভ’ ছিল না এবং পুলিশের সিভিল বা সাদা পোশাকে কোন টিম থাকবে না বা ডিউটি করতে পারবে না। সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি ব্যাংককর্মী গোলাম রাব্বী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাশকে পুলিশের নির্যাতনের বিষয় নিয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এত বড় পুলিশ বাহিনীতে দু’একটি ঘটনা ঘটেই যায়। কিন্তু সেজন্য তো কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। পুলিশ হোক বা সচিবালয়ের কর্মকর্তা হোক, কেউ আইনের উর্ধে নয়। যে কোন ঘটনার বিভাগীয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশী হয়রানির সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা রাব্বীর সঙ্গে এসআই মাসুদ পুলিশসুলভ আচরণ করেনি। প্রাথমিক তদন্তে মাসুদের পুলিশসুলভ আচরণ প্রতীয়মান হয়নি বলে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও তদন্তের জন্য আইজিপি নির্দেশ দিয়েছেন। সেই তদন্তের পর মাসুদ এবং যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আকাশের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে গাইডলাইন দেয়া হয় আর ইমপ্লিমেন্ট করে পুলিশ প্রশাসন। তবে সাদা পোশাকে অনেক সময় কৌশলগত কারণে ডিউটি দেয়। কিন্তু পুলিশ, ডিবি বা র‌্যাবের কটি থাকে, জ্যাকেট থাকে। ডিউটির সময় পুলিশের কটি বা জ্যাকেট থাকতে হবে এমন নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে পুলিশের সিভিল বা সাদা পোশাকে কোন টিম থাকবে না বলে নির্দেশনা রয়েছে। সেই সাদা পোশাকে থাকা পুলিশের হাতেই ডিএসসিসি কর্মকর্তা বিকাশ নির্যাতিত হন। অপরাধীর স্থান নেই পুলিশে ॥ ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার বাহিনীর ওপর চাপানো অসঙ্গত বলে জানানো হয়েছে পুলিশ সদর দফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে। সোমবার পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া এ্যান্ড পিআর) মোঃ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে পুলিশের কয়েকজন সদস্যের আচরণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এ সংক্রান্তে বাংলাদেশ পুলিশের বক্তব্য নিম্নরূপ ঃ বাংলাদেশ পুলিশের ১ লাখ ৬৯ হাজার সদস্য রাতদিন মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্মান, চলাফেরার নিরাপত্তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে আসছেন। সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ জীবনবাজি রেখে কাজ করছে। মানুষকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে ২০১৫ সালেই সন্ত্রাসীদের হামলায় পাঁচ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে এমন ত্যাগ পুলিশ ছাড়া অন্য পেশায় এদেশে বিরল। শীতের গভীর রাতে যখন সব মানুষ ঘুমোয়, তখন সেই ঘুম নিশ্চিত করতে রাত জেগে রাস্তায় ঘুরে পুলিশ। কোটি মানুষের ঢাকা শহরে অপ্রতুল রাস্তায় যখন গাড়ি এবং জনজীবন থমকে দাঁড়ায় তখন গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে বা জলমগ্ন রাস্তায় কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে মানুষের পথচলা নিশ্চিত করে পুলিশ। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা, বিপদে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় পুলিশই। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপরাধ রোধে কাজ করতে হয় পুলিশকেই। দিনে হোক, রাতে হোক সন্দেহভাজন স্থান এবং ব্যক্তিকে তল্লাশি করে সারা পৃথিবীর পুলিশ। এ কাজটি করার জন্য পুলিশকে যে আইনগত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে- সেটাও মানুষের নিরাপত্তার জন্যই। সেই রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের পৃথিবীর সব খানেই পুলিশ এই তল্লাশির কাজটি করে থাকে। এ কাজগুলো যদি না করা হয়- তাহলে সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা বিদ্যমান। সমাজের বৃহত্তর মানুষের নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে- সেটার ক্ষেত্রে আইনগত পদ্ধতি আছে। ব্যক্তির স্বাধীন সত্তার ওপর কতটুকু হস্তক্ষেপ করা যাবে সেই বিধিবিধান সম্পর্কে পুলিশের প্রত্যেক সদস্যকে প্রশিক্ষিত করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পুলিশের অধিকাংশ সদস্যই আইনগতভাবে কাজ করে। তবে বিচ্যুত হয় কেউ কেউ। কোন ব্যক্তির বিচ্যুতিকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয় না বাংলাদেশ পুলিশ। যারা অপরাধে জড়ায় তাদের পুলিশ হিসেবে নয়, অপরাধী হিসেবে এদেশের প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ পুলিশ। বরখাস্ত, চাকরিচ্যুত, বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে বের করে দেয়া হয় পুলিশ বিভাগ থেকে। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী ফৌজদারি আদালতেও বিচার করা হয় তাদের। সেক্ষেত্রেও সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। ২০১৫ সালে কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত ৭৬ জনকে বরখাস্ত/ চাকরিচ্যুত/বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। আলোচ্য দু’জনের ক্ষেত্রেও যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই যে, সততা, অসততা মানুষের ব্যক্তিগত গুণ বা দোষ। যে কারণে সমাজের কোন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় থেকেও কোন কোন ব্যক্তি অপরাধে জড়িয়ে যায়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষও সততার পরম উৎকর্ষতা দেখতে পারে, আবার প্রাসাদের বাসিন্দারাও অসততায় জড়িয়ে যায়। সাংগঠনিকভাবে, নীতিগতভাবে বাংলাদেশ পুলিশ কোন অপরাধ বা অপরাধীকে সমর্থন করে না। বরং অপরাধের শাস্তিটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সব সময়ই তৎপর। তাই কোন ব্যক্তির স্খলন বা বিচ্যুতির জন্য পুলিশ বিভাগকে সামগ্রিকভাবে দায়ী করা অসমীচীন এবং অসঙ্গত।
×