ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইলের পাশের জমি ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই ৪ কিমি রাস্তা তৈরিতে দিনরাত শ্রম দিচ্ছে

বগুড়ার প্রত্যন্ত গাঁয়ের মানুষের অনন্য দৃষ্টান্ত-

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

বগুড়ার প্রত্যন্ত গাঁয়ের মানুষের অনন্য দৃষ্টান্ত-

সমুদ্র হক ॥ পথের প্রয়োজনে পথে নামে গাঁয়ের মানুষ। নিজেরাই জমির অংশ ছেড়ে দিয়ে পথ বানিয়েছে। এই চিত্র বগুড়ার শেরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত কয়েক গ্রামের। বহু যুগ ধরে যাদের যোগাযোগের অবলম্বন ছিল জমির আইল। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বন্যা ঝড় তুফানে চরম ভোগান্তি মাথায় নিয়ে কাছের ও দূরের যাত্রায় চলাচল করতে হতো জমির আইলের ওপর দিয়ে। একটি পথ তাদের কষ্ট দূর করেছে। প্রমাণ দিয়েছে, পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিক পথের সৃষ্টি করে। প্রজন্মের শিশুরা প্রাথমিক পাঠে ভর্তি হওয়ার পর বুঝেছে স্কুলে যেতে হবে সরু আইলের ওপর দিয়েই হেঁটে। গ্রামের কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে, কোন প্রসূতির সন্তান জন্ম দেয়ার সময় প্রসবব্যথা উঠলে সাইকেল-ভ্যানে করে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া যেত না রাস্তা না থাকায়। কিছুটা পথ যে কোলে তুলে নিয়ে যাবে তাও সম্ভব ছিল না। কারণ উপজেলার মূল সড়কের মুখে পৌঁছতে আইলের ওপর দিয়ে পাড়ি দিতে হতো প্রায় চার কিলোমিটার। এই অবস্থায় কেউ বিকল্প উপায়ে কাঠের তক্তার ওপর কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে দুই প্রান্তে শক্ত লম্বা রশি এঁটে বাঁশের মধ্যে নিয়ে পালকির বহরের মতো রোগীদের নিয়ে যেত। কখনও এমন অবস্থাও হয়েছে গরজ বড় বালাই প্রবাদের কোন উপায় না দেখে লাশ বহনের খাটিয়ায় করে গুরুতর রোগীকে নিয়ে যেতে হয়েছে উপজেলা সদরে। রাস্তা না থাকায় গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতেও বেগ পেতে হয়েছে। গ্রামের মানুষের এমন দুর্ভোগে নিজেরাই নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে। শেরপুর উপজেলার বেলগাছি, কল্যাণী, চকবেলগাছি, আওলাকান্দি এই চার গ্রামের মানুষের সদরে যোগাযোগ করতে পাড়ি দিতে হয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ। আওলাকান্দি ও চকবেলগাছি পর্যন্ত কিছুটা কাঁচা পথ আছে ঠিকই তবে তা অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। বেলগাছি ও কল্যাণী গ্রামের মধ্যে রয়েছে ছোট একটি খাল। এই গ্রামগুলোর প্রায় ৭শ’ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উপজেলা সদর, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-হাটবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল দুর্গম বন্ধুর পথের মতো। ফসল উৎপাদনের পর বেচার জন্য হাট-বাজারে নিয়ে যেতে যে খরচ হতো তাতে অনেক সময় লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেত। এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই গত ডিসেম্বরের শুরুতে গ্রামের লোকজন একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় জমির আইলের মধ্যেই স্বল্প দূরত্বের পথ খুঁজে বের করতে হবে। আইলের ধারে যাদের জমি আছে তারা তা থেকে কিছুটা ভূমি রাস্তার জন্য ছেড়ে দেবে। তারপর প্রত্যেক গ্রামের মানুষ জমির মাটির ঢেলা ভেঙ্গে সমান করে পথ বানাবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গেই গ্রামের মানুষ এক জোট হয়ে রাস্তা তৈরির কাজে নামে। সাড়ে চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে স্বল্প দূরত্বের পথ আবিষ্কার করা হয় গ্রামের মানুষের জমির ধার দিয়ে। তারপর পাঁচ ফুট চওড়া রাস্তা বানানোর কাজ শুরু হয়। গত এক মাসে গ্রামের নারী-পুরুষ কোদাল ডালা ভাঁড় সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ নিজেদের শ্রমে মাটি কেটে সমান্তরাল করে রাস্তার কাজ প্রায় শেষ করেছে। বেলগাছি ও কল্যাণী গ্রামের মধ্যে একটি খালের (কোলাখাল নামে পরিচিত) ওপর বাঁশের প্রায় ৫০ ফুট সাঁকো বানিয়েছে। বেলগাছি গ্রামের শিক্ষক ফারুক আহমেদ স্বেচ্ছাশ্রমের নতুন রাস্তা সম্পর্কে জানালেন, বেলগাছি সেতুর পর ডান ধার দিয়েই এই রাস্তার শুরু। বেলগাছি, চকবেলগাছি-আওলাকান্দি-কল্যাণী গ্রাম পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার নতুন পথ উল্লিখিত গ্রামগুলোর প্রায় ৭শ’ পরিবার সদস্যদের (যা প্রায় তিন হাজার) দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর করবে। কল্যাণী গ্রামের কৃষক ফজলুল হক বললেন, গ্রামের ভেতর রাস্তা না থাকায় উৎপাদিত ফসল হাট-বাজারে নিয়ে যেতে কষ্ট হতো। ফসল বেচে যে লাভ হওয়ার কথা তা হতো না। এই পথ ফসল বেচে লাভের মুখ দেখার পথ করে দিল। আওলাকন্দি গ্রামের রহমত আলীর কথাÑ অসুস্থ রোগীকে ভাল চিকিৎসার জন্য উপজেলা সদরে নেয়া ছিল দুরূহ। এখন আর যাই হোক রিক্সাভ্যান ও ভটভটি (শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যান) তো ঢুকতে পারবে। ওইসব গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা বেজায় খুশি। আইলের ওপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার কষ্ট দূর হলো। চকবেলগাছি গ্রামের এক বধূ জানালেন, গ্রামে প্রবেশের সহজ রাস্তা না থাকায় অনেক সময় বিয়ে ভেঙ্গে যেত। গ্রামের মেয়র বিয়ের কথাবার্তা চলার সময় বরপক্ষ এমনও বলেছে জামাই আসবে কোন্ পথ দিয়ে। আবার ছেলের বিয়েতেও হবু শ্বশুরের স্বজনরা আইলের ভেতর দিয়ে মেয়েকে হেঁটে যাওয়ার অজুহাত তুলেছে। এখন সামাজিক বন্ধনের পথও তৈরি হলো। সুঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজের ইউনিয়নের মানুষের এমন কাজ দেখে গর্বিত হয়ে বললেন, ক্ষেতের জমি ছেড়ে দিয়ে রাস্তা বানিয়ে তারা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সম্মিলিত উদ্যোগে যে কত বড় কাজ হয় তা এই পথই দেখাল। একজন শিক্ষক বললেন প্রজন্মরা জানবে পূর্বসূরিরা জীবন চলার পথই বানিয়ে দিয়েছে।
×