ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রস্তাব সংসদীয় স্থায়ী কমিটির

দেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা যুদ্ধে অংশ নেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

দেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা যুদ্ধে অংশ নেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা

নাজনীন আখতার ॥ একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন সংজ্ঞায় সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেন সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি না হয় সেদিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কমিটিগুলোতে সংসদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করারও সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞার বিষয়টি বৈঠকে তোলেন কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ধারিত সংজ্ঞা প্রচার করা হয়েছে কি না এবং মুক্তিযোদ্ধারা তা জানেন কি না তা জানা দরকার। যেসব মুক্তিযোদ্ধা দেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন বর্তমান সংজ্ঞায় তাদের কথা বলা নেই। কাজেই এ সংজ্ঞা সংশোধন করে তাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করছে। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় করা হবে, কী পদ্ধতিতে করা হবে, পরিকল্পনা কি তা জানা দরকার। কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন সংজ্ঞা সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করবে কি না সে বিষয়ে জানতে চান। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পুনরায় নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণ, পূর্বের সঙ্গে কোন সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হবে কি না এবং কেন পরিবর্তন করা হলো তা জানা দরকার। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যে কোন সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’ এ সংজ্ঞার ব্যাখ্যা বা যেসব বিষয় বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা হবে সেগুলো হচ্ছে: যারা ভারতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যাদের নাম ভারতীয় তালিকায় আছে, লালমুক্তিবার্তায় যাদের নাম আছে, যাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ আছে, যেসব পেশাজীবী বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রেখেছেন, মুজিবনগর সরকারে যারা কাজ করেছেন, সশস্ত্রবাহিনী, আনসার, পুলিশ, ইপিআর (বিজিবি) সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ, এমপিএগণ, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত নারীগণ (বীরাঙ্গনা), স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীবৃন্দ, দেশের বাইরে দায়িত্বপালনকারী বাংলাদেশী সাংবাদিক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবাপ্রদানকারী সেবাকর্মী। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা (২৫১২/১৪) চলমান রয়েছে। এদিকে সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে আরও জানা গেছে, আফছারুল আমীন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, যেসব সংসদ সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধার ভারতীয় তালিকায় নাম, ভারতীয় প্রশিক্ষণ, মুক্তিবার্তায় নাম এবং বাংলাদেশ গেজেটে নাম আছে তাদের উপজেলা, জেলা ও মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটিতে সম্পৃক্ত করা হোক। সে সময় নবীন সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ছোট ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ও দেখার সুযোগ হয়নি সেসব সংসদ সদস্যদের ওই যাচাই-বাছাই কমিটিতে সম্পৃক্ত রাখার কোন সুযোগ আছে কি না? তার সঙ্গে একমত পোষণ করে সংসদীয় কমিটির আরেক সদস্য কামরুল লায়লা জলিও জানতে চান, যেসব সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা নন তারা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য না হয়েও অন্য কোনভাবে কমিটিতে উপস্থিত থেকে কমিটির কার্যক্রম দেখার সুযোগ পাবেন কি না? জবাবে সংসদীয় কমিটির সদস্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বৈঠকে বলেন, সংসদ সদস্যরা যাচাই-বাছাই কমিটিতে সম্পৃক্ত থাকলে কোন সমস্যা নেই। যেসব সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা নন, তারা পর্যবেক্ষক হিসেবে যাচাই-বাছাই কমিটিতে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন। তবে সংসদ সদস্যরা যাচাই-বাছাই কমিটিতে যে প্রতিনিধি দেবেন তারা যেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হন সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। এছাড়া বৈঠকে আফছারুল আমীন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিংসা তহবিল গঠনের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে আর মুক্তিযুদ্ধ হবে না। এদেশের মানুষ আর মুক্তিযুদ্ধ দেখবে না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জীবদ্দশায় ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, হার্ট এবং কিডনি সমস্যার মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। তাকে সমর্থন দিয়ে কমিটির সভাপতি জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার অনুকূলে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা দেয়ার জন্য মন্ত্রীর অনুমোদনের ক্ষমতা থাকার সুপারিশ করেন। তিনি হাটবাজার আয়ের ৪ শতাংশ অর্থ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন চালানো ও সংগঠন শক্তিশালীকরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা, সেমিনার করার জন্য পরামর্শ দেন। মন্ত্রী জানান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদে বর্তমানে কর্মরত ১০৩ জনের মধ্যে এক চতুর্থাংশ জনবল রাখার শর্তে ২ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ৪ শতাংশ হাটবাজার আয়ের ৫০ শতাংশ বেতনভাতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, বাড়ি নির্মাণ, লেখাপড়া ও বিয়ে খাতে ব্যয় করতে পারবে।
×