ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ভূমিকম্প কিয়ামতের আলামত

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ভূমিকম্প কিয়ামতের আলামত

গত ৪ জানুয়ারি (২০১৬ইং) ভোর ৫টা ৬ মিনিটে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ। আমার সকাল ৫টায় ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই এই কাঁপুনির ধাক্কায় বুক কেঁপে উঠল। রাস্তায় শোরগোল ভারি হয়ে উঠল। ৭ তলায় থাকি। এক বাসিন্দা তো তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে বেঁহুশ হয়ে পড়লেন। আমি তো মোটামুটি জীবনে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের সাক্ষাত পেয়েছি। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর আমার শ্বশুর সাহেব যশোরের খড়কীর পীর শাহ্ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন (রহ.)-এর মুবারক দেহ কবরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠেছিল। সে ভূমিকম্প সারা বাংলাদেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতেও অনুভূত হয়েছিল। তিনি যে যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহ্র ওলি ছিলেন তা প্রমাণিত হয়েছিল। তার জানাজায় কয়েক লাখ লোক শরিক হয়েছিলেন। বর্তমান লেখক তাঁর জানাজার সালাতে ইমামতি করেছিলেন। একদিন সমগ্র পৃথিবী মহাপ্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পনের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিয়ামতকে কুরআন মজীদে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। একে সা’আতও বলা হয়েছে। প্রকৃত কিয়ামত যখন আসবে তখন সমগ্র পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। সেই মহাপ্রলয়ঙ্করী কিয়ামত যে সংঘটিত হবে এতে কোন সন্দেহ করার অবকাশ নেই, কিন্তু তা কবে হবে তা একমাত্র আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুই জানেন। তবে এতটুকু জানা যায় সেদিন হবে কোন এক আশুরার দিন শুক্রবার। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া আন্নাস্ সা’আতা আতিইয়াতুল্ লা রায়বা ফিহা- এবং নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুত সময় (সা’আত) আসবেই, এতে কোন সন্দেহ নেই। (সুরা হজ্জ: আয়ত ৭)। কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে কুরআন মজীদে ও হাদিস শরীফে বিশদ বিবরণ যেমন রয়েছে, তেমনি কিয়ামতের ঘটনা সম্পর্কেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কী? মহাপ্রলয় সম্বন্ধে তুমি কী জানো? সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো এবং পাহাড়-পর্বত হবে ধুনিত রঙিন পশমের মতো। (সূরা আল-কারি’আঃ আয়াত ১-৫)। হাদিস শরীফে কিয়ামতের যে সমস্ত আলামতের উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ভূমিকম্প, ভূমিধস, কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়ায় প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্য পর্যন্ত ঢেকে যাওয়া ইত্যাদি। কিয়ামতের আলামত তখনই দেখা দেয়ার কথা বলা হয়েছে যখন নানামাত্রিক অনাচার, পাপাচার এবং ব্যভিচারের প্রাদুর্ভাব প্রকট আকার ধারণ করবে। কিয়ামত নজদিক বা কিয়ামত আসন্ন হয়ে পড়বে যখন মিথ্যাচারের প্রাদুর্ভাব হবে, মাদক সেবন ও মদ্য পান বেড়ে যাবে, ব্যভিচার মহামারী আকার ধারণ করবে, প্রকাশ্য স্থানে ব্যভিচার ঘটতে থাকবে, নির্লজ্জ-বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা বৃদ্ধি পাবে, সন্তান মাতা-পিতার অবাধ্য হবে, মাতা-পিতাকে পর মনে করবে, স্ত্রীর তাঁবেদারি করবে, শাসনকর্তা জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার ও অপচয় করবে। ত্রিশ জন ভ- নবীর আবির্ভাব ঘটবে, নতুন নতুন রোগ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটবে, মসজিদে উচ্চবাচ্য ও অশ্লীল কথাবার্তা হবে, স্ত্রীলোকের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি হবে, মানবিক মূল্যবোধ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাবে, ধর্মের নামে ভ-ামি বৃদ্ধি পাবে, দাজ্জাল ও কায্যাবের আবির্ভাব ঘটবে। প্রবঞ্চকদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা কথাবার্তায় নবীদের মতো হবে, কাজেকর্মে ফেরাউনের মতো হবে এবং অন্তরে হবে হিংস্র বাঘের মতো। অন্য বর্ণনায় কুলুবুহুম কুলুবুশ শায়াতিনÑ তাদের অন্তর হবে শয়তানদের অন্তরের মতো, দুনিয়াজুড়ে অনাচার, অত্যাচার বেড়ে যাবে। কিয়ামতের আলামত দুই প্রকারের আর তা হচ্ছে আলামতে সুগ্রা-ছোটে ছোটে আলামত আর আলামত কুব্রা বড় বড় আলামত। কিয়ামত শব্দটি কুরআন মজীদে সত্তরটি স্থানে উল্লিখিত হয়েছে আর সা’আত শব্দটি ৪০টি স্থানে এসেছে। কিয়ামত দিবসকে ইয়াওমুদ্দীন-কর্মফল দিবস, ইয়াওমুল কারীআ-আঘাতকারী বা মহাপ্রলয় দিবস, ইয়াওমুল বা’স পুনরুত্থান দিবস, ইয়াওমুল হাক্কাহ্- অবশ্যম্ভাবী দিবস, ইয়াওমুল আখিরাত- শেষ দিবস ইত্যাদি বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে। কুরআন মজীদে যেমন কিয়ামতের আলামতে ভূমিকম্পের কথা বলা হয়েছে, তেমনি সমুদ্র তলদেশে ভূকম্পনে উথলে উঠে পানির প্রচ- তোড়ে স্থল ভাগে ব্যাপক ধ্বংস কা-েরও উল্লেখ রয়েছে, যেমন ইরশাদ হয়েছে : যখন সূর্যকে নিষ্প্রভ করা হবে, যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে, পাহাড়-পর্বতকে যখন চলমান করা হবে, যখন পূর্ণগর্ভা উষ্ট্রী উপেক্ষিত হবে, যখন সব বন্য জীবজন্তু একত্র করা হবে, সমুদ্র যখন স্ফীত করা হবে (ওয়া ইয়াল বিহারু সুজ্জিরাত)। (সূরা তাকভীর : আয়াত ১-৬)। কুরআন মজীদে সমুদ্রে ভূমিকম্পের উল্লেখ আরও দৃষ্ট হয়। এ সমস্ত বিবরণ এ জন্যই কুরআন মজীদে এসেছে যাতে মানুষ সত্যের আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারে, হিদায়াত লাভ করে আখিরাতের কল্যাণের নিশ্চয়তা লাভে নিজেকে ধন্য করতে পারে। ইসলামে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কোন স্থান নেই, বরং ওগুলোকে উৎখাত করে আলোকিত বিশ্বাস ও আলোকিত সংস্কারের পথের দিশা ইসলাম দিয়েছে। কিয়ামতের আলামত দেখা দিলে আলোকিত মানুষের মনে আল্লাহ্র গজবের কথা স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। আমরা ওই সব গজবকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলি। যাই বলি না কেন আসল কথা হচ্ছে তা অত্যন্ত ভয়াল ও ভয়ঙ্কর, তা খুবই প্রলয়ঙ্করী। সমুদ্র-ভূকম্পনের উল্লেখ করে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ইযাস্ সামাউন ফাতারাত, ওয়া ইযাল কাওয়াকিবুন, তাছারাত, ওয়া ইযাল বিহারু ফুজ্জিরাত-আসমান যখন বিদীর্ণ হবে, যখন নক্ষত্রম-লী বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে, সমুদ্র যখন উদ্বেলিত হবে। (সূরা ইন্ফিতার : আয়াত ১-৩)। পৃথিবীর জীবনই কারও একমাত্র জীবন নয়, এর পরও আছে আর এক জীবন, সেই জীবনই হলো অনন্ত জীবন। পৃথিবীর জীবনের কর্মের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা অশান্তি-শান্তি। কুরআন মজীদে সত্যকে প্রত্যাখ্যানকারী এবং আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারীদের ওপর আল্লাহ্র গজব নেমে আসার অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে, যেমন আল্লাহ্ দ্রোহী ফেরাউন সসৈন্যে সমুদ্রে ডুবে মারা গেল, অন্যদিকে হযরত মূসা ‘আলায়হিস্ সালাম সদলবলে সমুদ্রের বুকে সৃষ্ট শুকনো রাস্তা দিয়ে ওপারে চলে গেলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : অতঃপর মূসার প্রতি ওহী করলাম, তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রে আঘাত কর। ফলে তা (সমুদ্র) বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড়ের মতো হয়ে গেল। আমি সেখানে উপনীত করলাম অপর দলটি (ফেরাউন বাহিনী)-কে এবং আমি উদ্ধার করলাম মূসা ও তাঁর সঙ্গী সকলকে, তারপর নিমজ্জিত করলাম অপর (ফেরাউন) দলটিকে। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। (সূরা শু’আরা : আয়াত ৬৩-৬৭)। সমুদ্রে ভূমিকম্প বা সুনামি যে যাই বলি না কেন তা কিয়ামতের কথাই স্মরণ করে দেয়। প্রত্যেকের মৃত্যুই তার জন্য কিয়ামতসদৃশ। কিন্তু সেখানেই জীবনের সমাপ্তি ঘটে না। বড় কিয়ামত যখন আসবে এবং হাশরের ময়দানে সমবেত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে তখন যাতে আমরা আল্লাহ্র নেকবান্দা এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের অনুগত উম্মত হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারি, সে জন্য আমাদের পৃথিবীর জীবনেই সত্য-সুন্দরের পথে চলতে হবে, সৎকর্ম করতে হবে, মানবিক মূল্যবোধকে আত্মস্ত করতে হবে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়া ইন্নি লাগাফ্ফারুল্ লিমান তাবা ওয়া আমানা ওয়া ‘আমিলা সলিহান ছুম্মাহ্ তাদা- এবং আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি যে তওবা করে, ইমান আনে, সৎকর্ম করে ও সৎপথে অবিচল থাকে। (সূরা তাহা : আয়াত ৮২)। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×