ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের অযৌক্তিক দাবিতে বিস্মিত বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

পাকিস্তানের অযৌক্তিক দাবিতে বিস্মিত বাংলাদেশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশী কূটনীতিক মৌসুমী রহমানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই দাঁড় করাতে পারেনি পাকিস্তান। আর কোন ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহারের দাবিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান সরকারের এমন ধরনের সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের জন্য সহায়ক নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। এদিকে বুধবার রাতে মৌসুমী রহমানকে ইসলামাবাদ থেকে পর্তুগাল বাংলাদেশ মিশনে পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানায়। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন পাকিস্তান হাইকমিশনের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারের প্রতিবাদে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের এ ধরনের দাবি পুরোপুরি অযৌক্তিক। কেননা ফারিনা আরশাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়ে বলা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তবে বাংলাদেশের কূটনীতিকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি পাকিস্তান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের কূটনীতিককে প্রত্যাহার করতে বলেছে দেশটি। এটা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য সহায়ক নয়। কারণ বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে কেন প্রত্যাহার করতে হবে এর কোন ব্যাখ্যা পাকিস্তান দিতে পারেনি। ঢাকা থেকে তাদের একজন কূটনীতিককে প্রত্যাহার করতে বলার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান এখন মুখ রক্ষার চেষ্টা করছে বলেও তিনি জানান। শাহরিয়ার আলম আরও বলেন, আমরা ধৈর্য সহকারে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক রাখার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। সূত্র জানায়, গত বছর ২৯ নবেম্বর পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস শেখ ঢাকায় গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পরে ইদ্রিস শেখ আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতায় ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসীমের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। ইদ্রিস ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানে যান। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানী এক নারীকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছিলেন। ২০০২ সালে দেশটির ‘পাক-মুসলিম এ্যালায়েন্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে বিশেষ সখ্যও গড়ে ওঠে। এরপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসে ইদ্রিস জেএমবির সঙ্গে যোগ দেন। বাংলাদেশে আসার পর পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের সঙ্গে পরিচয় হয় ইদ্রিসের। এরপর তিনি নিয়মিত পাকিস্তান গত ২ বছরে ৪৮ বার বাংলাদেশ-পাকিস্তান যাতায়াত করেছেন ইদ্রিস। তার প্রধান কাজ ছিল বাংলাদেশে জেএমবির কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। জেএমবি সদস্যদের ছোট ছোট দলে পাকিস্তানে পাঠিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার বাংলাদেশে ফেরত আনা। মূলত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যেই কাজ করেছিলেন ইদ্রিস। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ দিনের সুসর্ম্পক নষ্ট করতেই পাকিস্তানে তৈরি জালমুদ্রা বাংলাদেশে আনতেন। এসব জালমুদ্রা বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পথে ভারতে পাঠানো হতো। আর এসব কাজে জড়িত ছিলেন ফারিনা আরশাদ। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফারিনা আরশাদকে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়। সে অনুযায়ী গত ২৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। তবে ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ থাকলেও মৌসুমীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অযাচিতভাবে পাকিস্তান মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করতে বলেছে। তবে কেন প্রত্যাহার করতে হবে সে বিষয়ে পাকিস্তানের কোন বক্তব্য নেই। এর আগেও গত বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা মাজহার খান জাল টাকা লেনদেনে অভিযুক্ত হন। মঙ্গলবার ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনকে ডেকে নিয়ে মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহারের দাবি জানায় দেশটি। তবে কেন মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করতে হবে সে বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ঢাকা থেকে পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব ফারিনা আরশাদকে জঙ্গী অর্থায়নে সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান সরকার। এর আগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে মৌখিকভাবে ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়। পাকিস্তান সরকার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এবার বাংলাদেশী কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহারের দাবি জানায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মৌসুমী রহমানকে ঢাকায় ফেরত আনা হচ্ছে না। তাকে ঢাকায় না এনে পর্তুগালের বাংলাদেশ মিশনে পাঠানো হয়েছে। লিসবনে বাংলাদেশ দূতাবাসে তাকে ইতোমধ্যেই পদায়ন করা হয়েছে। ইসলামাবাদে বাংলাদেশ মিশনের কনস্যুলার (রাজনৈতিক) পদে কর্মরত ছিলেন মৌসুমী রহমান। তিনি নবেম্বরের শেষ ও ডিসেম্বরের শুরুতে দুই সপ্তাহ ইসলামাবাদে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের দায়িত্বও পালন করেন। তখন পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে দুই দফা তলবও করে। এদিকে হইকমিশনার সোহরাব হোসেন ছুটি শেষে ইসলামাবাদ ফিরে গেছেন। শীঘ্রই তিনি বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন। আগামী জুলাই মাসে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলেও সরকার আগেই সোহরাব হোসেনকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছে।
×