ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজসেবা দিবস ও সমাজসেবা সপ্তাহ উদ্বোধন

ভিক্ষুক-ছিন্নমূল মানুষ দেখামাত্র পুনর্বাসনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

ভিক্ষুক-ছিন্নমূল মানুষ দেখামাত্র পুনর্বাসনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশের পাশাপাশি ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষের সরকারের তরফ থেকে বিনাখরচে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, এই ভিক্ষাবৃত্তি যেন কেউ করতে না পারে। তাদেরকে এই ধরনের নিকৃষ্ট কাজ করতে দেয়া হবে না, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে বিনা সুদে ঋণ দিয়ে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। কারণ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উন্নতি ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তিনি ফুটপাথে বা রাস্তায় ভিক্ষুক-ছিন্নমূল দেখামাত্র পুনর্বাসন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন। শনিবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় সমাজসেবা দিবস ও সমাজসেবা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ভিক্ষাবৃত্তির মতো অসম্মানজনক পেশা বন্ধ করতে হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এতিমদের অর্থ চুরি বা আত্মসাত করার জন্য নয়, বরং জনগণ ও সমাজের সেবা করার জন্য আমরা সরকারে এসেছি। আমরা এতিমদের কিছু দেয়ার জন্য এসেছি। কারণ আমরা আমাদের বাবা-মাকে হারিয়ে এতিম হয়েছি। আমি ও শেখ রেহানা ছাড়া আর কেউ এতিম হয়ে এত কষ্ট পায়নি। সেবামূলক কর্মকা-ের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিদেশ থেকে টাকা এনে আত্মসাতের উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসচ্ছল, পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নই আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে সরকারের ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচী’, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’, প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেয়াসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভিক্ষাবৃত্তিটা যেন কোন কোন লোকের পেশায় দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের আবার সর্দার থাকে। যা পায় তারা আবার ভাগবাটোয়ারা করে। যতই পুনর্বাসন করি না কেন, আবার তাদের ফেরত নিয়ে আসে। এটা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের জন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। বিনা পয়সায় ঘর দিচ্ছি। ট্রেনিং দিচ্ছি। তাদের ঋণ দিচ্ছি। যেন নিজেদের পায়ে তারা দাঁড়াতে পারে। দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেন, তাদের (ভিক্ষুক) ঘর-বাড়ি লাগলে, বিনা পয়সায় আমরা ঘর-বাড়ি করে দেব। জীবন-জীবিকার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আমরা করে দেব। কিন্তু এই ধরনের হীন কাজ তারা করতে পারবে না। সে ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। গৃহহীনদের বিনা খরচে বাসস্থান করে দেয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, শীতের সময় রেলস্টেশনে ফুটপাথে, এখানে সেখানে মানুষ পড়ে থাকতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গেই পুনর্বাসন করতে হবে। ফুটপাথে ও রেলস্টেশনে যারা বসবাস করে ও ঘুমায়, তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজ সেবা অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমরা খোঁজ নিব যে, তারা কোন গ্রাম থেকে এসেছে। তাদের যদি কোন ঘর-বাড়ি না থাকে তাহলে আমরা তাদের জন্য বাড়ি তৈরি করব। প্রয়োজন হলে আমরা প্রথম ছয় মাস তাদেরকে বিনামূল্যে খাবার দেব। তিনি বলেন, তারাও মানুষ। তাদেরও উন্নত জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। তারা কেন ফুটপাথে বা রেলস্টেশনে বসবাস করবে বা ঘুমাবে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্র এ বিষয়ে সকল দায়িত্ব নেবে। বিভিন্ন মেয়াদে তাঁর সরকার অসচ্ছল, অক্ষম ও সুবিধাবঞ্চিত লোকদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে অক্ষম লোকদের জন্য ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৩৬০ কোটি টাকায় উন্নীত করা, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এক লাখ লোকের পুনর্বাসন, ১ কোটি ২০ লাখ ভূমিহীন লোকের মধ্যে ৫৫ লাখ একর ভূমি বিতরণ এবং হিজড়া, দলিত ও বেদে সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে যেভাবে পারে, কাজ করে খাবে। বাংলাদেশ তখনই উন্নত সমৃদ্ধ হবে, যখন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। তিনি বলেন, এদেশে কোনো মানুষ একেবারে গরিব থাকবে না। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনমান যেন উন্নত হয়, সে লক্ষ্য নিয়েই কিন্তু আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে। একেবারে হতদরিদ্র এবং সমাজের নিম্নস্তরে পড়ে থাকা নাগরিকদের উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ দরিদ্র থাকবে না, উন্নত হবে, সমৃদ্ধশালী হবে। সে লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। সমাজসেবাকে প্রতিটি রাজনীতিকের দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে রাজনীতিটা করি, তার মূল লক্ষ্যটাই হচ্ছে সমাজের সেবা করা। জাতীয় সমাজসেবা দিবস ২০১৬ ও সমাজসেবা সপ্তাহের এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সমাজসেবার প্রচেষ্টা এগিয়ে যাবে দেশটা’। এই প্রতিপাদ্যকে অত্যন্ত যুগোপযোগী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মনে করি, আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে দেশটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হিসাবে গড়ে তুলতে হবে এবং এই উন্নয়নের ধারা সমাজের সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘রূপকল্প-২০২১’ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার ও টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, অসহায় দুঃস্থ নারীদের ভাতা, অক্ষম ও অসচ্ছলদের জন্য ভাতা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার অবহেলিত দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণে ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে এবং ইতোমধ্যেই ন্যাশনাল সোস্যাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি পেপার অনুমোদন করেছে। বিভিন্ন খাতে বর্তমান সরকারের অসাধারণ সাফল্যের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে আর কোন ক্ষুধার্ত মানুষ নেই এবং দেশ এখন দারিদ্র্যমুক্ত। আমরা দারিদ্র্য হার ৪৫ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে কমিয়ে এনেছি এবং জনগণের আয়ের ব্যবধান কমিয়েছি। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে যারা একদা উপেক্ষা করত তারাও এখন এ দেশকে সম্মানের চোখে দেখছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরা বিজয়ী জাতি এবং আমরা আমাদের মাথা উঁচু করে রাখতে চাই। আমাদের লক্ষ্য, সকল স্তরের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের একটি ‘রোল মডেল’ এবং এ দেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আমরা দেশকে ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত করব। শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো বন্ধে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব তরিকুল ইসলাম, সমাজসেবা অধিদফরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির প্রমুখ। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দু’জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ‘ব্রেইল’ বই হস্তান্তর করেন এবং সরকারী শিশু পরিবার থেকে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত মেধাবী ৭ শিক্ষার্থীর মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। এছাড়া সরকারী শিশু পরিবার থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে এখন পুলিশে কর্মরত একজন নারী ও পুরুষ কনস্টেবলকে সফল সদস্য হিসেবে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। পরে প্রধানমন্ত্রী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
×