ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কাঁচা মরিচের ঝালও ছিল

বছরজুড়েই পেঁয়াজ নিয়ে ছিল সিন্ডিকেটের কারসাজি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২ জানুয়ারি ২০১৬

বছরজুড়েই পেঁয়াজ নিয়ে ছিল সিন্ডিকেটের কারসাজি

এম শাহজাহান ॥ ভাতের সঙ্গে এক টুকরো মুরগির মাংস না হলে খেতে চায় না আট বছরের শিশু আরাফ হোসেন। এজন্য প্রতিদিনের খাবারের ম্যানুতে মুরগির একটি আইটেম রাখেন গৃহকত্রী-মা শিরিন আখতার। যোগান মেটাতে সাপ্তাহিক বাজারে তার মুরগি চাই-ই চাই। পরিবারটির জন্য স্বস্তির খবর হলো-গত এক বছরে দেশে মুরগির মাংসের দাম বাড়েনি। ককটেল, লেয়ার, ব্রয়লার, পাকিস্তানী ও দেশীসহ বাহারী নামের সব ধরনের মুরগির দাম ছিল স্থিতিশীল। মুরগির পাশাপাশি চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দামও বাড়েনি। এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের বাজারও অস্থিতিশীল হতে পারেনি। তবে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে বিদায়ী বছরে সবজির বাজারে অস্থিরতা থাকলেও মৌসুমী আবাদ ভাল হওয়ায় শীতে দাম কমতে শুরু করেছে। পেঁয়াজ নিয়ে বছরজুড়েই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছিল। তাদের এই কারসাজিই ভোগ্যপণ্যের বাজারে কলঙ্কের তিলক এঁকে দিয়েছে। ভারতের রফতানি মূল্য কমিয়ে দেয়া এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভাল হওয়ার সুবাদে পেঁয়াজের দাম এখন স্থিতিশীল। সহনীয় মূল্যে বর্তমান ৩০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে প্রতিকেজি পেঁয়াজ। বিদায়ী বছরে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল বলে ভোক্তা সংগঠন কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সম্প্রতি তাদের এক পর্যবেক্ষণে বলেছে। সংগঠনটির মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যসহ কিছু পণ্যের মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে তার তেমন প্রভাব পড়েনি। গত ২০১৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৮ ভাগ এবং পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৪ দশমিক ৮১ ভাগ। এর আগে ২০১৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত এক বছরে দেশী ও আমদানিকতৃ পেঁয়াজ এবং কাঁচা মরিচের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বলে ক্যাবের পর্যবেক্ষণ। ওই সময় দেশী পেঁয়াজ ৭৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭৪ দশমিক ০২ শতাংশ। কাঁচামরিচে বেড়েছে ২৯ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর ফলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বেড়েছে। সংগঠনটির মতে, বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে ডালডা ও ঘি-তে, ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। আটা-ময়দায় কমেছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, চালে ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, ভোজ্যতেলে ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, সুগন্ধি চালে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, গুঁড়ো দুধে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং লবণে শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ। একই সঙ্গে ডিমে ১৩ দশমিক ৬, ডালে ৮ দশমিক ২, গুড় ও চিনিতে ১ দশমিক ৯ এবং ফলমূলে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ দাম বেড়েছে। পাশাপাশি ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। জানা গেছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় বিদায়ী বছরে মূল্যস্ফীতি পাগলা ঘোড়া হয়ে উঠতে পারেনি। বরং মূল্যস্ফীতি এখন স্থিতিশীল। এছাড়া বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকার কারণেও দেশে কোন পণ্যের দাম বাড়তে পারেনি। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম ৩৫-৩৬ ডলারে নেমে এসেছে। ফলে তেল আমদানিতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে আগের তুলনায় অর্ধেক। এখন আর সরকারকে তেলে ভর্তুকি দিতে হয় না। বরং মুনাফা হচ্ছে। এর বাইরে কৃষিতে ধারাবাহিকভাবে ভাল ফলন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাড়তি সুফল বয়ে এনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর কারণেই কৃষিতে এ সাফল্য। এজন্য ভোগ্যপণ্যের বাজারও স্থিতিশীল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ২০১৫ সালে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূলস্ফীতি সহনীয় পর্যায়েই ছিল। সর্বশেষ নবেম্বর মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির হার কমে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কমে আসছে সবজির দাম ॥ টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে বিদায়ী বছরে সবজির দাম ছিল চড়া। ওই সময় ৭০-৮০ টাকার নিচে কোন সবজি ছিল না। সেই দাম কমে এখন ২৫-৩০ টাকায় নেমে এসেছে। সবজি উৎপাদনে চাষীরা এগিয়ে আসায় ইতোমধ্যে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহও বাড়ছে। তাই মৌসুমী সবজিতে স্বস্তি ভোক্তাদের। দাম কমে আসায় সবজি কেনাকাটাও তাই বেড়েছে বছরের অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। ক্রেতা বাজারে ঢুঁ মেরেই কিনছেন সবজি। বিক্রেতা দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, শিম, বেগুন, লাউ, লাল ও পালং শাকসহ কত কি! এক মাস আগে যেখানে হাতেগোনা কয়েকটি সবজির ওপর নির্ভর ছিল কাঁচাবাজার সেখানে এখন আইটেমের শেষ নেই। বছরজুড়ে পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি ॥ বিদায়ী বছরজুড়েই পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করেছে পণ্যটির সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। এমনকি দেশীয় পেঁয়াজের মজুদকারীরা কারসাজি করায় ভোক্তাকে শেষ পর্যন্ত ৮০-৯০ টাকায় প্রতিকেজি পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) খোলা ট্রাকে ৫০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করে। এছাড়া পেঁয়াজের ওপর থেকে সব ধরনের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার, চীন, পাকিস্তান এবং তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ইতোমধ্যে ভারত রফতানি মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া দেশীয় নতুন পেঁয়াজও ওঠা শুরু হয়েছে। বাজারে এখন প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। ঝাল বেড়েছিল মরিচের ॥ বিদায়ী বছরে কাঁচামরিচেরও ঝাল বেড়েছিল। দাম বাড়ায় ওই সময় প্রতিকেজি মরিচ ভোক্তাকে ২০০-২৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে। মরিচের দাম বাড়ায় শেষ পর্যন্ত ভারত থেকে আমদানি করে বাজার স্থিতিশীলের উদ্যোগ নেয়া হয়। এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ায় আর আমদানি করতে হচ্ছে না। সহনীয় মূল্যে ভোক্তা এখন মরিচ কিনতে পারছে।
×