ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রথমবারের মতো  দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন। দেশের ৩২৩ পৌরসভার মধ্যে ২৩৪টিতে এবারই প্রথম দলীয়ভাবে বিজয়ী হবেন মেয়র প্রার্থীরা। প্রশ্ন হলো- কেমন হলো দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের নির্বাচন? পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশঙ্কা এমনকি পাতানো নির্বাচনেরও অভিযোগ করা হয়েছিল। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো বলেই দিয়েছিলেন, সিটি কর্পোরেশন মতো সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে। যদিও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ মঙ্গলবারের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে এসব কথা বলেন এরশাদ। বুধবার দিনভর নির্বাচন কমিশনের কাছে পরস্পরবিরোধী অভিযোগ দিয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। সবকিছুর পরও বিএনপি ও জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ায়নি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে নানান আশঙ্কার পরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন কার্যত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এতে একমত নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। তাছাড়া প্রতিবার নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ, সহিংসতা স্বাভাবিক নিয়মে রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অনিয়ম বা সহিংস ঘটনা বেশি তা বলা যাবে না। সব মিলিয়ে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান খুব একটা বাড়তি উত্তাপ ছড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত বিএনপির নির্বাচনে থাকার বিষয়টিকে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। কেমন হলো দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচন- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অন্য সময়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে এবারকার নির্বাচনের পার্থক্য অনেক। তবে নির্বাচনের মূল্যায়ন এ মুহূর্তে নয়। তিনি বলেন, এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে থেকেছে এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। এখন ফলাফল দেখলে সার্বিক মূল্যায়নের বিষয়টি সামনে আসবে। ইতিহাস ॥ বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল ইমপ্রুভমেন্ট এ্যাক্টের মাধ্যমে ১৮৬৪ সালে অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও যশোরে প্রথম পৌরসভা স্থাপিত হয়। পৌরসভাগুলোতে প্রথম নির্বাচনের প্রবর্তন করা হয় ১৮৭৩ সালে। ১৮৭৬ সালের পৌর আইনে পৌরসভাগুলো চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ১৮৬৪ সালের পৌরসভাগুলোকে প্রথম শ্রেণীর, ১৮৬৮ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত পৌরসভাগুলোকে দ্বিতীয় শ্রেণীর, ১৮৫৬ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত পৌরসভাগুলোকে ইউনিয়ন এবং ১৮৫০ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত পৌরসভাগুলোকে স্টেশনের মর্যাদা দেয়া হয়। এরপর ১৯৩২ সালে আরও একটি পৌর আইন পাস করা হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কারণে পৌর প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। পূর্ববঙ্গে (সিলেটসহ) ৫৬টি পৌরসভা পড়েছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও কমিশনার পৌরবাসীর ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান চালু করা হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর সকল পৌরসভার কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর সকল পৌরসভার কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালে নতুন আইনে পৌরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও কমিশনারগণ ভোটে নির্বাচনের বিধান চালু করা হয়। ১৯৭৭ সালে পৌর অর্ডিন্যান্সে ভাইস চেয়ারম্যান পদ তুলে দেয়া হয়। কমিশনারের সংখ্যা পৌরসভার আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিন্যাস করা হয়। ১৯৯৯ সালে সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড থেকে একজন করে মহিলা কমিশনার নির্বাচনের বিধান করা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে পৌরসভার চেয়ারম্যানদের পদবি মেয়র এবং কমিশনারদের কাউন্সিলর করা হয়। এ বছর প্রথম দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অভিযোগের পর অভিযোগ ॥ আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভড়াডুবি হবে। ৮০ ভাগ ভোট পাবে বিএনপি। অর্থাত বেশিরভাগ প্রার্থী নির্বাচিত হবে বিএনপি সমর্থিত। কিন্তু একদিন পরই আবার ভোল পাল্টান তিনি। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রহসনের নির্বাচনের অভিযোগ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, পৌর নির্বাচনকেও প্রহসনে পরিণত করার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, সরকারী দলের সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে এবং সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আবারও সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করছি। বাস্তবে এমন অভিযোগের সত্যতা খোদ বিএনপির পক্ষ থেকেও খুব একটা দিতে পারেনি। এছাড়াও খালেদা জিয়া বলেন, এই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। গণতন্ত্র ও আন্দোলনের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিএনপি ভোটযুদ্ধে থাকছে। নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে ভোটারদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। এরশাদও নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেন। দলীয় প্রার্থীদের হুমকি, মামলা দেয়াসহ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। যদিও নির্বাচনের দিন তিনি আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিক্রিয়া দেননি। ইসি কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮ সালের ৯ পৌরসভা নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৯৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০১১ সালে চার ধাপের পৌর ভোটে বাক্সে পড়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে অংশ নেয়া ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে তেমন কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ২০ দলের শরিকদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। নির্বাচন নিয়ে তিন দলের শেষ কথা ॥ নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ যাবতকালের অনুষ্ঠিত সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে পৌরসভা নির্বাচন সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এ কথা বলেন। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন, সরকার ও বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ জানান আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। মাহবুব-উল আলম বলেন, বিএনপি বলেছে ৬০টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। এটা যদি সত্যিও ধরে নেয়া হয় তাহলেও ৩ শতাংশের কম জায়গায় এটা হয়েছে, যা খুবই নগণ্য। বিএনপি এসব পৌরসভায় নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিতর্কিত করার জন্য অনিয়মের অভিযোগ করেছে। এর কোন সত্যতা নেই। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, সরকারের নীল নকশা অনুযায়ী আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন হয়ে গেল। তিনি বলেন, এতদিন আশঙ্কা করেছিলাম প্রহসনের একটা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই প্রমাণ হয়েছে। তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে কোনদিন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। যতদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়, ততদিন হতে দেবে না। বিকেল চারটা পর্যন্ত যতটুকু খবর পেয়েছি, তাতে ১৫৭টি পৌরসভায় ধানের শীষের এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- জাপা ॥ জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ বলেছেনে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় আমরা সন্তুষ্ট নই এবং এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বুধবার বিকেলে জাতীয় পার্টির কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরী সংবাদ সম্মেলনে দলের নেতারা এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জাতীয় পার্টির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব এ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, সকাল ৮টা থেকে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় আমাদের প্রার্থীদের এজেন্টদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতিসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে রেজাউল বলেন, সার্বিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ২৬টি পৌরসভায় পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি জানান তিনি।
×