ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়তি ভাড়া নিলে জেল-জরিমানা ;###;গ্যারেজে-রাস্তায় নামবে মোবাইলকোর্ট

অটোরিক্সা নৈরাজ্য রোধে বছরের শুরুতেই ॥ বিশেষ অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫

অটোরিক্সা নৈরাজ্য রোধে বছরের শুরুতেই ॥ বিশেষ অভিযান

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অটোরিক্সার নৈরাজ্য রোধে নতুন বছরের শুরু থেকেই আটঘাট বেঁধে মাঠে নামছে সরকার। বাড়তি জমা রোধে অভিযান চলবে গ্যারেজে। দুই শিফটে অটোরিক্সা চালানো রোধে নেয়া হচ্ছে বিশেষ পদক্ষেপ। যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে রাস্তায় থাকবে পাঁচটি মোবাইল কোর্ট। চালকদের বিরুদ্ধে জরিমানার পাশাপাশি কারাদ-েরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে পুলিশী তৎপরতা। কোন অবস্থাতেই ঢাকাসহ বাইরের তিন জেলার সাধারণ কিংবা প্রাইভেট ১০ হাজার অটোরিক্সা নগরীতে চলতে পারবে না। নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব পরিবহন চলাচল করলে এক মাসের জন্য ডাম্পিং ও জরিমানা করা হবে। এদিকে ১০ দফা দাবিতে তিন জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে ডাকা অটোরিক্সা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন। ১ নবেম্বর থেকে অটোরিক্সার নতুন ভাড়া ও জমা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। প্রায় ছয় হাজার অটোরিক্সা মালিকের বিরুদ্ধে বাড়তি জমা ও দুই শিফটে গাড়িভাড়া দেয়ার অভিযোগ ওঠে। তেমনি চালকদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের শেষ ছিল না। চুক্তিতে চলা, স্বল্প দূরত্বে না যাওয়া, বাড়তি টিপস নেয়া ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। অথচ এসব নৈরাজ্য বন্ধে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স কার্যত নীরব ছিল। অপরাধ চলছে, অথচ দেখার যেন কেউ ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে দৈনিক জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে অটোরিক্সা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এরপর সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন। বিআরটিএ কার্যালয়ে টাস্কফোর্সের বৈঠক আহ্বান করা হয়। এতে পরিবহন শ্র্রমিক, মালিকদের প্রতিনিধিসহ পুলিশের প্রতিনিধি, সড়ক বিভাগ, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অটোরিক্সার নৈরাজ্য রোধে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে। অটোরিক্সা নৈরাজ্য রোধ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, বাড়তি ভাড়া ও জমার বিরুদ্ধে বিআরটিএর পক্ষ থেকে অভিযান চলছে, যা আরও জোরদার করা হবে। তিনি জানান, এছাড়াও বিআরটিএর পক্ষ থেকে মনিটরিং টিম মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। বাড়তি ভাড়া বা জমা নেয়ার কোন অভিযোগ পেলে এই টিমের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি। বিআরটিএ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হলে এসব অপরাধ কমে আসবে বলেও তিনি মনে করেন। বৈঠক সম্পর্কে অটোরিক্সা মালিক সমিতির সভাপতি বরকতউল্লাহ বুলু জনকণ্ঠকে বলেন, দুই শিফটে গাড়ি চালানো বন্ধ ও ৯০০ টাকার বেশি কোন অবস্থাতেই অটোরিক্সা জমা রাখা যাবে না। মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে নতুন বছরের শুরুতেই অভিযান শুরু হবে। আমরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছি। পাশাপাশি সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছি। তিনি বলেন, কোন চালক মিটারে অটোরিক্সা না চালালে আগে শুধু জরিমানা করা হতো। এখন একই অপরাধে কারাদ- ও জরিমানা করা হবে। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলার রেজিস্ট্রেশনবিহীন বা প্রাইভেট অটোরিক্সা নগরীতে চলাচল বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকেও সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এসব গাড়ি রাজধানীতে চললে এক মাসের জন্য ডাম্পিং করা হবে। তিনি বলেন, সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করলে অটোরিক্সা সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব। আমরা চাই এ সেক্টরে মালিক ও চালকদের নৈরাজ্য বন্ধ হোক। মালিক-চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ॥ বাড়তি জমা আদায়ে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ও জমার তোয়াক্কা করছেন না সিএনজিচালিত অটোরিক্সা মালিক ও চালকরা। ইচ্ছেমতো চালকদের কাছ থেকে জমা নেয়া হচ্ছে। সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত জমা আদায়ের অভিযোগ মিলেছে। অন্তত ছয় হাজার গাড়ি মালিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ। স্বল্প দূরত্বে ও মিটারে যেতে নারাজ চালকদের কেউ কেউ। বিলের পাশাপাশি ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের থেকে। সব মিলিয়ে নগরীতে চলা প্রায় ১২ হাজার ৭১৫ অটোরিক্সার বেশিরভাগই এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এক নবেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার ভাড়া ও জমা পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। মালিকদের জমা বাড়িয়ে ৬০০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ৯০০ টাকা। নতুন ভাড়া অনুযায়ী প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়াও তাই। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া সাত টাকা ৬৪ পয়সার স্থলে ১২ টাকা করা হয়েছে। যানজট বা অন্য কোন কারণে রাস্তায় বিরতিকালে প্রতি মিনিটের ভাড়া এক টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। ভাড়া নির্ধারণী কমিটির সদস্যরা বলছেন, সঠিক ব্যয় বিশ্লেষণ করা হলে কোন অবস্থাতেই মালিকের জমা ৯০০ টাকা হবে না। তবুও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতেই মালিকদের ক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা বলছেন, ব্যয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ৩০০ কার্যদিবসকে বছর ধরা হয়েছে। এই হিসেবে ব্যয় ধরা হয় ৮৫২ টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিনের গ্যারেজ ভাড়া হিসেবে আটচল্লিশ টাকা যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীতে মালিক সমিতির আবেদনের প্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জমা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা চূড়ান্ত হয়। শ্রমিক নেতাদের অভিযোগÑ সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করার পরও একশ্রেণীর গ্যারেজ মালিক চালকদের জিম্মি করে দারোয়ানের নামে গাড়িপ্রতি সর্বোচ্চ ৭০ টাকা পর্যন্ত প্রতিদিন আদায় করছেন। ফলে চালকদের সধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। মূলত এসব কারণেই কিছু চালক মিটারে যেতে রাজি হন না। পাশাপাশি অনেকে মিটারে গেলেও বাড়তি টিপস হিসেবে যাত্রীদের কাছ থেকে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা। প্রায় ছয় হাজার গাড়ি চলছে দুই শিফটে ॥ ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের হিসাব মতে, সরকারী নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা করে প্রায় ছয় হাজার অটোরিক্সা চলছে দুই শিফটে। এর মধ্যে দুই হাজার ২৩৩ গাড়ির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়সহ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমোদিত অটোরিক্সা রয়েছে ১২ হাজার ৭১৫। মিশুকের পরিবর্তে আরও ৪১৫ নতুন অটোরিক্সা নামানো হয়েছে। প্রাইভেট অটোরিক্সার নামে রাজধানীতে ভাড়ায় চলছে প্রায় ছয় হাজার গাড়ি। এছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা জেলা মিলিয়ে আরও চার হাজার অটোরিক্সা অবৈধভাবে রাজধানীতে চলাচল করছে। ধর্মঘট প্রত্যাহার ॥ বাড়তি জমা আদায় বন্ধ, এক শিফটে গাড়ি চালানোসহ ১০ দফা দাবিতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিআরটিএসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন। আগামী ২ জানুয়ারির মধ্যে এসব দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া না হলে ৩ জানুয়ারি থেকে ঢাকা মহানগরীতে লাগাতার অটোরিক্সা ধর্মঘটের কথা ছিল। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকে ১০ দফা দাবি-দাওয়া পর্যায়ক্রমে পূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ৩ জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে আহুত অনির্দিষ্টকালের অটোরিক্সা ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও টাস্কফোর্সের সদস্য মোহাম্মদ হানিফ খোকন জনকণ্ঠকে বলেন, বৈঠকে প্রাইভেট অটোরিক্সায় যাত্রী বহন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পার্কিং জোন স্থাপনের জন্য বিআরটিএর পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেয়া হবে। মালিকদের বাড়তি জমা বন্ধের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এছাড়াও অটোরিক্সা চুরি, ছিনতাই ও চালক হত্যা রোধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা জানান তিনি। হানিফ খোকন জানান, মালিকরা সরকার নির্ধারিত জমার চেয়ে গাড়িপ্রতি বাড়তি ৪০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। এ সমস্যা সমাধানে গ্যারেজ থেকে চালক গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় রশিদে সময় উল্লেখ থাকবে। এছাড়াও জমা দেয়ার সময় উল্লেখসহ রশিদে টাকার পরিমাণও লেখা থাকবে। গ্যারেজ মালিক ও চালকরা অভিযানের সময় এসব রশিদ প্রদর্শন করতে না পারলে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বিআরটিএ বৈঠক থেকে।
×