ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চুক্তি অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চুক্তি অনুমোদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের সব থেকে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চুক্তি অনুমোদন করা হয়েছে। প্রায় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিদ্যুতে কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে রুশ ফেডারেশনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। সরকার একক উৎস হিসেবে এটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের কাছ থেকে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সকল সহায়তা গ্রহণ করবে। এই প্রথম দেশে একক কোন প্রকল্পে এক লাখ কোটি টাকার উপরে ব্যয় করা হচ্ছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলছে এখন নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। তবে নির্মাণ চুক্তি কার্যকর হবে ঋণ চুক্তির পর। আগামী মার্চ বা এপ্রিলে এই ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। আর ২৫ ডিসেম্বর স্বাক্ষর হতে পারে রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি। এদিকে কর্ণফুলী টানেলের কাজ পাচ্ছে চীনা কোম্পানি সিসিসিসি। মন্ত্রিসভা কমিটি এ বিষয়ক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে বুধবার ওই চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়। বৈঠকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানসহ ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মূল চুক্তি। গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এটি অনুস্বাক্ষর করেছে রাশিয়া এবং বাংলাদেশ। চুক্তিতে বিদ্যুত কেন্দ্রটির নক্সা, যন্ত্রাংশ সরবরাহ, বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, উৎপাদন, নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি, পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ, বিদ্যুত কেন্দ্র পর্যন্ত যন্ত্রাংশ পরিবহন এবং গ্যারান্টি পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন সেবা প্রদানের কথা উল্লেখ করেছে। আগামী ২৫ তারিখ রূপপুরের চুক্তিটি হতে পারে বলে রাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। রাশিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে ১৩ দফা আলোচনার ভিত্তিতে ৪৭টি অনুচ্ছেদ এবং ৫৭৩টি উপ-অনুচ্ছেদের চুক্তিটি চূড়ান্ত করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল সৃষ্টি করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে। এরপর মূল বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রটির নক্সা প্রণয়নের কাজ শেষ করেছে এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের অক্টোবরে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। অন্যদিকে এর এক বছর পর দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ অক্টোবরে উৎপাদনে আসবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি ৫০ বছর ধরে বিদ্যুত উৎপাদন করবে। যদিও প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রধম ইউনিট বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে উৎপাদনে আনতে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে রাশিয়া ওই অনুরোধের প্রেক্ষিতে বলছে ওই সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতির বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণকে দেখাতে সক্ষম হবে তারা, যা দেখে বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার ক্লাবে প্রবেশ করছে। কেন্দ্রটির জন্য পারমাণবিক জ্বালানি রাশিয়ার কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হবে। ব্যবহার শেষে ওই জ্বালানি বর্জ্য ফেরত নেবে রাশিয়া। এজন্য পৃথক একটি জ্বালানি লিজ চুক্তি হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব থাকবে রাশিয়ার। এজন্য আলাদা কোন খরচ ধরা হবে না। বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের খরচের মধ্যেই এই খরচ ধরা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের যে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্য থেকেই বাংলাদেশের এক হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেবে রাশিয়া। বিদ্যুত কেন্দ্রের সকল যন্ত্র পানি পথে আনা হবে। এজন্য সুবিধাজনক স্থান দিয়ে নৌরুট খনন করা হবে। মোট ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল্য ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ২৫৩ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুত কেন্দ্রের ভূমি উপযুক্ত করার জন্য ৫৪৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। এছাড়া ইতোমধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার জন্য ব্যয় হওয়া ৫৫১ মিলিয়ন ডলার বাদ যাবে। এছাড়া অতিরিক্ত ব্যয়ের সম্ভাবনা বিবেচনা করে ৪০০ মিলিয়র ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মোট প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে রাশিয়ান ঋণ ১১ দশকি ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশর সরকারের তহবিল থেকে এক দশমিক ২৬৫ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল সাত বছর ধরা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের সময়কাল ২৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ বছর গ্রেস প্রিরিয়ড রয়েছে। ছয় মাসের লাইবরের সঙ্গে এক দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হবে। তবে কোনক্রমেই বছরে চার ভাগের বেশি সুদের হার হতে পারবে না। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সময় ৬ মাসের লাইবর ছিল দশমিক ৪৯ ভাগ কিন্তু এখন তা বেড়ে হয়েছে দশমকি ৮০ শতাংশ। সেই হিসেবে এখন সুদের হার দাঁড়ায় দুই দশমিক ৫৫ শতাংশ। লাইবরের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে দেখা গেছে আগামী ৫-৬ বছরে লাইবর খুব বেশি বৃদ্ধি পাবে না। তবে লাইবর যতই বৃদ্ধি পাক সুদের হার কোন সময়ই বছরে ৪ ভাগের বেশি হতে পারবে না। মোট প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৯০ ভাগ রাশিয়া সরবরাহ করবে। তবে ১০ ভাগ অগ্রিম পরিশোধ বাবদ বাংলাদেশকে দিতে হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রাশিয়াতে অর্থনৈতিক বছর হিসেব করা হয় জানুয়ারি থেকে আর আমাদের এখানে হিসেব করা হয় জুলাই থেকে। সে হিসেবে প্রথম অর্থবছরে কেন্দ্রটির কাজ শুরু করতে আর্থিক সঙ্কট কাটাতে এ উদ্যোগ। মন্ত্রণালয় বলছে ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর ডিসেম্বরে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। এরপরই বিদ্যুত কেন্দ্রটির মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য আগেই সম্ভাব্য যাচাই শেষ করা হয়েছে। করা হয়েছে নক্সা। ভূমিকম্প বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে এই কেন্দ্র স্থাপনের নক্সা করা হবে। রূপপুরের মাটি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযোগী নয়। এজন্য জার্মানির প্রযুক্তিতে সেখানের মাটি যথাযথ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ৫৪৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশে ভিভিইআর-১২০০ প্রযুক্তি রিএকটর ব্যবহার করা হবে। এটা সর্বশেষ প্রযুক্তি। সংশিèষ্টরা জানান, নতুন প্রযুক্তিতে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফুকুসিমা দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে কোন কোন বিষয়ে সমস্যা হতে পারে তা বিবেচনায় এনে এই প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা খুবই কম। তারপরও কোন দুর্ঘটনা হলেও তার কোন তেজস্ক্রিয়তা বাতাসে সহসা ছড়াবে না। এমনকি দুর্ঘটনা হলেও ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুত কেন্দ্র নিজেই তার তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকতে পারবে। ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। এটি তৃতীয় প্রজন্মের রিএকটর। সুতরাং সবচেয়ে নিরাপদ হবে। আর তাছাড়া যে কোন পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রধান বিষয় থাকে নিরাপত্তা। নিরাপত্তা সবার আগে নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র করতে গেলে প্রতিটি ধাপে ধাপে জাতিসংঘের তদারকির মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। জাতিসংঘের পারমাণবিক বিভাগ নিশ্চিত করলে বা তারা নিরাপদ মনে করলেই তা বাজারজাত করা সম্ভব হয়। নিরাপত্তার বিষয়টি তারাও যাচাই করবে। এই প্রযুক্তিতে ভিভিইআর-১০০০ থেকে অনেক ভাল হবে। কর্ণফুলী টানেলের কাজ পেল চীনা কোম্পানি সিসিসিসি ॥ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে যুক্ত করার কাজের ঠিকাদার নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকার। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে (সিসিসিসি) এই কাজ দেয়া হয়েছে। এই টানেল নির্মাণকে ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ অভিহিত করে সরকারের প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে সরকার চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, পাঁচ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এ টানেল নির্মাণ হবে। ভ্যাটসহ খরচ দাঁড়াবে ছয় হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে যুক্ত করতে গত ২৪ নবেম্বর সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছিল একনেক। জ্বালানি তেল ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন ॥ ১১ লাখ ৬ হাজার টন জ্বালানি তেল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির ১২টি প্রস্তাব বুধবার উত্থাপন করে জ্বালানি বিভাগ। বৈঠক শেষে জানানো হয়, চলতি বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকে চীনের জিনহুয়া অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি ব্যারেল সাড়ে ৪ ডলার ব্যয়ে ৩০ হাজার টন পরিশোধিত গ্যাস অয়েল আমদানি করবে সরকার। একই মেয়াদে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টন, জুলাই থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকে ওমানের ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে প্রতি ব্যারেল সাড়ে ৪ ডলার দামে ৩০ হাজার টন গ্যাস অয়েল, ব্রুনাইয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত পিবি ট্রেডিং সেনডিরিয়ান বারহাদের কাছ থেকে একই মেয়াদে প্রতি ব্যারেল সাড়ে ৪ মার্কিন ডলার ব্যয়ে ৬০ হাজার টন গ্যাস অয়েল, মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লেবুন কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে ২ লাখ ৭৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল, গ্যাস অয়েল ও জেড ওয়ান ফুয়েল আমদানি করবে।
×