কবির সুমনের গান ধরে যদি বলি ‘কে বড় পাগল কবি না কবিতা’ সে সবের সুফল ব্যাখ্যা মেলানোও বড় দায়। আসলে এ সবের ব্যাখ্যার দরকার খুব একটা পড়ে না। তাই বেহুদা ভাবনার পথে না হাঁটি। কবিতা শিল্প-সাহিত্যের সৌকর্যময় জায়গা। কবিতা ছেলে খেলানির জায়গা নয়। আবার কবিতা শখের বিষয়ও নয়। কবিতা কখনও অন্যের প্ররোচনা থেকে উঠে আসে না। কবিতা সত্যিকারের শিল্পবোধের জায়গা। কিন্তু কবি হওয়ার নিরন্তর বাসনা সবারই কাজ করে।
তাই আপাতত নিম্নের লাইনটি খুব মনে পড়ছে Ñ
‘কবি ডুবে মরে কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে’
হৃদি ভেসে যায়- জয় গোস্বামী
কবির এই সরল পঙ্ক্তিই সায় দেয় সত্যিকারের কবির টিকে থাকার বিষয়ে। একই বাক্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, কবি ডুবে মরে আবার অকপটে বলে দিলেন কবি ভেসে যায়। ডুবে মরার ক্ষেত্রে অস্তিত্বকে বিলীন হওয়া বুঝায়। আবার কবি ভেসে যায়, সেক্ষেত্রে আমরা বুঝি পাঠ ও পাঠকের অন্তরে কবির প্রবাহমানভাবে টিকে থাকা ।
দৈনিক অনেকেই কোমরকে আঁটসাঁটভাবে বেঁধে কবিতার ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে কবিতার ময়দানে। ওই যে প্রথমেই খানিকটা বলেছি কবিতা একটা দীর্ঘ সাধনার ফল। আঁধারের নৈঃশব্দতা খুঁড়ে খুঁড়ে কবির অন্তলীনের স্ফুরণ যে যে কবিতা। তা ধরা পড়ে একেকজনের কাছে একেক অভিধায়। আর তা না হলে কবিতার সার্থকতাও থাকে না। রূপে রঙে তা বহুদা বর্ণ ধারণ করে চলে নদীর বাঁকের মতো। কবিতা নিরূপণের জন্য নির্দিষ্ট কোন বাটখারা নেই। তাই এ বিষয়ে মাতবরি ফলানো সমীচীনও নয়।
নতুন কবি, পুরাতন কবি, তরুণ কবি এ সবে তেমন আগ্রহও নেই। এ কথা প্রথাবদ্ধ সত্য, আমরা সব সনাতনের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি। সমকালের তরুণদের কবিতা নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকায়। সময় হয়নি। আসলেই কী তাই? আপত্তি যারা উঠান তাদের প্রতি ঘোরতোর আপত্তি।
কবিতার বিস্তৃতি খাতায় যে তরুণদের আঁকিবুকি দেখি তাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। তাদের কবিতা চর্চার এক দশক অতিক্রম হয়েছে। তাই তাদের মূল্যায়নের সময়ও এসেছে। যদি নির্মলেন্দু গুণের সেরা কাজটির কথাই বলি প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ দেখুন কত বছর বয়সে লিখেছেন? আবুল হাসান তো সাতাস বছর বয়সেই গতায়ু হলেন। আধুনিক বাংলা সেরা কবিতার মধ্যে তার ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ রয়েই যাবে। শহীদ কাদরীর কথাই যদি ওঠে তাহলে ‘সহসা সন্ত্রাস ছুইলো আমাকে’ সেই কোন কালেই না লিখেছেন! যৌবন বয়সেই হেলাল হাফিজ যৌবনের ঐক্যতান গাইলেন, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।
যাই হোক ভাল কিছু নির্মাণের যথেষ্ট বয়স এই তরুণদের হয়েছে। বয়সের ফ্রেমে কবির সৃজনী সত্তা ঠেকে থাকে না।
আলাদা কাব্যভাষা নির্মাণে বাঁকবদলের সারথি হয়ে থাকবে আজকের দূরগামী তরুণ প্রজন্ম। তাদের মধ্যে সম্ভাবনাময় গুটিকয়েক তরুণের কবিতা নিয়ে এই সরল আয়োজন। বলে রাখা ভাল স্বজন ও সৃজনের সদ্ভাব নয় এ আয়োজন।
আগুনে পুড়ছি, নিঃশ্বাসে ঝরছে
কামনার বৃষ্টি;
কালো টিপ আর কাজল পরা হয়নি আজ।
সুপ্ত পঙ্ক্তির জালও বুনিনিÑ
কেননা আজ কাছাকাছি পাইনি তোমায়
সুপ্ত পঙ্ক্তি Ñ সিকতা কাজল
তরুণ কবি সিকতা কাজলের ছোট এই কবিতায় সহজ সরল উপস্থিতির মাধ্যমে তার আগমনী হাওয়া ইতোমধ্যেই কাব্য পাড়ায় বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। সহজ কথার ভিতর দিয়ে গল্পের আবহে কবিতা তৈরি করার ক্ষেত্রে বেশ তার কবিতা মনোমুগ্ধকর লাগে বটে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বাতাসের সাঁকো’ ২০১৫ প্রকাশিত হয়েছে।
‘কষ্টের পাতাবাহার বেষ্টিত স্মৃতির বেলকোনি
বহুদিন বন্ধ-পরিত্যক্ত পালকির মত
ঝুলেপরা চামরা ঘেরা ধূসর সে চোখের মত’
একরঙা রঙধনুÑ রিমন মোরশেদ
এখানে রিমন মোরশেদের কাব্যে দৃষ্টিনীয় হয়ে উঠেছে উপমা উৎপেক্ষার ব্যবহার। শব্দের দ্যোতনায় পাঠককে নিয়ে গেছেন স্মৃতির ধূসর সাম্রাজ্যে।
‘প্রান্তর ঘাসের বুকে পোড়াআত্মার ফসিল রেখে শিশির হবো কুয়াশা ভোরে-
আলো চুম্বনে ঝলমল করবে হীরের দ্যুতি রাতের পাঁজর ফুঁড়ে অন্ধকার পিছনে
রেখে অবিরাম বাজাবো যৌবন ক্বাসিদাÑ নগ্নআব্রু পৃথিবীতে উলঙ্গ সাপের
নাচ নাচাবো বিষের তাড়নায়Ñ ’
জিপসি মনÑ কিশোার মাহমুদÑ
কিশোর মাহমুদ কবি হিসেবে খুব শক্তিমজ্জা বহন করেন। তার কবিতায় মিথ ও পুরাকীর্তির যথাপোযুক্ত ব্যবহার। তাকে একজন আশাবাদী কবি হিসেবে দেখতে পাই। উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিমালায় বলেছেন ‘নগ্নআব্রু পৃথিবীতে উলঙ্গ সাপের নাচ নাচাবো বিষের তাড়নায়’। পৃথিবীকে নগ্নআব্রুর সাথে তুলনা করেছেন। পরক্ষণেই কবি বলে দিলেন, সাপের নাচ দেখাবো বিষের তাড়নায়। বিষের তাড়নায় শব্দটির মাধ্যেমে, যাপিত জীবনে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠার উদাত্ত আহ্বান।
‘এরচে’ তন্দ্রার ভিতরে যে দুপুর
মরে যেতে বসেছিলো
তার সাথে রঙ্গিন পতঙ্গের মতো
দল বেঁধে উড়ে যাওয়া
ভালো ছিলো...’
নিমজ্জনÑ রুদ্র হক
রুদ্র হকের কবিতা বাচনভঙ্গিতে প্রাঞ্জলতার দাবিদার। পরিমিত শব্দজালের আবহে পাঠককে নিয়ে যায় দূর থেকে আরও দূরে।
জব্বার আল নাঈমকে কবিতার ক্ষেত্রে বলব তিনি একজন রাজসিক কবি। ‘তাড়া খাওয়া মাছের জীবন’ ২০১৫ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একজন উচ্চমার্গীয় কবি তিনি। তার কবিতা নিয়ে বাংলা কবিতার জীবন্তকিংবদন্তী আল মাহমুদও লিখেছেন। তাই জব্বার আল নাঈমের কবিতাকে ব্যবচ্ছেদ করাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার বটে।
জলজোয়ারে লবণের বসবাস দেখে অন্ধকার সময়কে ভেবেছি কুঁড়েঘর;
তার কাটায় পুঁতেছি শরীরের সব ওয়াদা।
কেউ বুঝুক আর না বুঝুক ভগবান পছন্দ করে বেকার জব্বার
সময় সন্মান করে না বলে পুজো দেই বারবার ।
আত্মকথন -জব্বার আল নাঈম
এই সাহসী কবি গল্পের ছলে কবিতার বয়ানে আস্ফালন ঘটালেন। সমূহ সামজিক দৃষ্টির আদল রয়েছে তার নিরেট কবিতায়।
‘হেনরি মুরের
ভাস্কর্য হয়েছিল যে ভিক্ষুক
পা নেই তার, তবু বাঁশের কঞ্চির মত হাত
বৃষ্টিতে ভিজেছিল সম্পূর্ণ, পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিল
বাংলাদেশ ব্যাংক’
হেনরি মুরের ভাস্কর্য Ñ মোস্তাফিজ কারিগর
মোস্তাফিজ কারিগর প্রথমত, এক শিল্পী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। কিন্তু মোস্তাফিজ কারিগর যে একজন কবিতারও যে কারিগর তা প্রমাণ করে দেন তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নৌকাখ-ে দেবীদ্বারে’। অসাধারণ শব্দ ও সুরের মেলবন্ধনে কবিতার শরীরের বাতাবরণ করেছেন এই কবি।
‘ঝিনুক, সেও তো খোলসবন্দী, প্রদাহ তার বিষের বালিতে
মজনু নকি ফিরে গেছে নজদ বনে, জায়নামাজ ডিঙান
কণ্টাকাকীর্ণ হৃদয় তার লাল গোলাপি রক্তে গেছে ছেয়ে’
প্রদাহÑ শফিক
শফিক লিটনের কবিতার পুরান ও মিথ ব্যবহারের জৌলসতা রয়েছে। কবিতার শরীরের তার নিরলস অবস্থান রয়েছে।
তাদের কথা হলো সিঁড়ি বিষয়ক।
জীয়ন্ত দাঁতের উন্মাদ হাসি
ফেটে পড়ল চতুর্দিক
আর সুড়ঙ্গমুখী একটা ঊর্ণনাভ
কেঁপে কেঁপে ক্ষুধার্ত বাদুরের মতো
ঝুলে পড়ল নিজস্ব জালে
নাটক- শঙ্খচূড় ইমাম
শব্দের জাল খুড়ে খুড়ে ভাববন্ধনে কবি শঙ্খচূড় সমসাময়িকদের থেকে অগ্রগণ্য বলব না বরং তিনি স্বতন্ত্র চিন্তার প্রতিফলনে যথেষ্ঠ পারঙ্গমতা দেখিয়ে চলছেন।
পাখি হলাম কত রাত পরে! পাখিরা কি নদীর উৎপত্তি খুঁজে পায়? গর্ভসুখী
নারীর মতো নদী কি হেসেছিল পাখি দেখে? নদী কি পাখির ঠোঁটে নেমে
এসোছিল রবিশস্যের মতো কোনোদিন!
ঋণÑ মাহী ফ্লোরা
অপূর্ব গল্পবান্ধব কবি মাহী ফ্লোরা। শব্দ ও সুরের দ্যোতনায় কবিতাকে গভীর ভাববন্ধনে আবদ্ধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। নিজস্বতা কবিকে টিকিয়ে রাখে । এই কবি আলাদা একটা টোন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে। সমূহ ভবিষৎ রয়েছে তার কবিতার। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম সে এক আশ্চর্য জলপ্রপাত, চন্দ্রহারা মানবীর চুল থেকে জল ঝরে, সবুজ বোতাম এবং অন্যান্য, ম্যাচবাক্স।
চঞ্চল মাহমুদের ধারাবাহিক লিরিক একটা শক্তিশালী ধাঁচ তৈরিতে সফল হয়েছেন। রাত উল আহমেদ, রাসেল আহমেদ বেশ সচেষ্ট রয়েছেন কবিতায়।
সমকালের কাব্যদেবীর ঘাড়ে চড়ে যারা নিয়মিত লিখে চলছেনÑ তৌহিদ ইমাম তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘একটি জীবন কৃষ্ণপক্ষ’ ২০১২, রনি বর্মন, সদি শাশ্বত, অজিত দাস, সুমন মাহমুদ, অনায়ত, অমিত আশরাফ, আজিম হিয়া, আবু নাসিব, ইলিয়াস কমল, কালাম আজাদ, খালেদ চৌধুরী, জিয়াবুল ইবন, তানজিম আতিক, তানজীর মেহেদী, তারেক আহসান, নিলয় রফিক, মহিম সন্ন্যাসী, রজতসিকস্তি, রাশেদ শাহরিয়ার, সাম্য রাইয়ান, সাজ্জাত সাফি, সফি রিয়াদ কামাল, সুজন আহমেদ, হিজল জোবয়ের, গালিব রহমান তাসনুভা অরিণ, তানজিন তামান্না।
শীর্ষ সংবাদ: