ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্স ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

সরকার হার্ডলাইনে, শুরু হয়েছে বিশেষ অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২০ আগস্ট ২০১৫

সরকার হার্ডলাইনে, শুরু হয়েছে বিশেষ অভিযান

শংকর কুমার দে ॥ দেশের অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে হার্ডলাইন বেছে নিয়েছে সরকার। শিশু নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দস্যুতা এবং জঙ্গীবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনাসহ কঠোর এ্যাকশনে চলে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারী দলই হোক আর বিরোধী দলই হোক না কেন, কোন ছাড় দেয়া হবে না, জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশে দেশব্যাপী অঘোষিত বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু হয়ে গেছে। র‌্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর এ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশের পর সরকারী দলের ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মী-ক্যাডার ক্রসফায়ার বা বন্ধুকযুদ্ধে নিহত, আহত, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এতে দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডে ভয়ভীতি, আতঙ্কের সৃষ্টি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ইতিবাচক ফল বয়ে আনার ইঙ্গিত দেখা দিয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। রাজধানীর হাজারীবাগে ও মাগুরায় পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ছাত্রলীগের বর্তমান এবং সাবেক দুই নেতা। মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে সরকারী দলের সমর্থক ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতার ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের মধ্যে পলায়নমুখী প্রবণতা শুরু হয়েছে। রাজধানীর হাজারীবাগে গতকাল মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়া (২৮)। রাজা মিয়া (১৬) নামে এক কিশোরকে চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার প্রধান আসামি ছিলেন আরজু মিয়া। তবে স্বজনদের দাবি, সন্ধ্যায় তাকে ধরে নিয়ে ভোরে হত্যা করেছে র‌্যাব। অপরদিকে মাগুরায় ছাত্রলীগের গোলাগুলিতে মায়ের জঠরে শিশু গুলিবিদ্ধ ও একজন বৃদ্ধ নিহত হওয়ার মামলার তিন নম্বর আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আজিবর শেখ (৩৪) সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মাগুরার পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আজিবর মাগুরা পৌর ছাত্রলীগের আগের কমিটির সাবেক নেতা। মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে সরকারী দলের সমর্থক ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক দু’জন কর্মী ক্রসফায়ার বা বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান পরিচালনা ও কঠোর এ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশের পদক্ষেপ বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে এক অনির্ধারিত আলোচনায় অপরাধী দলের হলেও ন্যূনতম কোন সহানুভূতি দেখানো হবে না বলে জানিয়ে দেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তারপর এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে, এ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, অপরাধী যেই দলেরই হোক না কেন, অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। চলতি আগস্ট মাসে সরকারী দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের টেন্ডার, ব্যবসা-বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় একাধিক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। বাড্ডায় ঝুট ব্যবসা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন নেতা খুন হয়েছেন। জাতীয় শোক দিবসের দিন কুষ্টিয়ায় খুন হয়েছেন এক যুবলীগ নেতা। চাঁদপুরের কচুয়ায় চাঁদার দাবিতে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রীদের ওপর যুবলীগের হামলার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং রাজধানীর হাজারীবাগে ছাত্রলীগ নেতার এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি সঙ্কট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জোটের কর্মী-ক্যাডারদের ব্যাপক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপরাধী কার্যক্রমের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রথমে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর মাধ্যমে ক্লিনহার্ট অপারেশন অভিযান পরিচালনা করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের চালু করা হয়। তারপর র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সৃষ্টি করে চালু করা হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ক্রসফায়ার। এই পক্রিয়ায় সন্ত্রাস দমন করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও দেশ-বিদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে সন্ত্রাস দমনের জন্য মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর হাজারীবাগ ও মাগুরায় সরকারী দলের সমর্থক ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতার ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনা আবারও কি সন্ত্রাস দমনের পূর্ববর্তী সরকারের পথই বেছে নেয়ার ইঙ্গিত বহন করছে। গত এক সপ্তাহে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অন্তত তিনজন নিহত হন এবং এই তিনজনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী। পুলিশ সদর দফতরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, শিশু রাজন, রাকিবসহ অনেক শিশুকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা এবং কয়েকটি নারী ধর্ষণ ও লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কার বিষয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। তারপরই সরকারী দলের কর্মী-ক্যাডারদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ও বেপরোয়া আচরণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও অশান্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দেয়। এছাড়াও বেশ কয়েকজন ব্লগার হত্যাকা- ও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত দাবি করে জঙ্গী সংগঠন বিশেষ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ জেএমবি, হুজি, হিযবুতের তৎপরতা, আইএস জঙ্গী সংগঠনে যোগ দেয়ার প্রবণতা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। এ জন্যই অঘোষিতভাবে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর এ্যাকশনে চলে গেছে।
×