ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়

সাংবিধানিক পদ, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৬ আগস্ট ২০১৫

সাংবিধানিক পদ, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ

পৃথিবীতে কিছু কিছু বিষয় আছে যা সহ্য করা খুবই কঠিন। যেমন ৩২ নম্বরের বাড়ি। ওই বাড়ির সামনে বা ভেতরে খুব বেশি সময় কখনও দাঁড়াতে পারিনি। শরীর ও মন পারে না সে ভার বহন করতে। নিজেকে তখন শাপগ্রস্ত অহল্যার মতো পাষাণ মনে হয়। আর আগস্ট মাসে যেন এ ভার আরও বেশি ভারি হয়। শেখ হাসিনা কীভাবে এ ভার বহন করে সারাবছর শুধু নয়, আগস্ট মাসেও দশ হাতে কাজ করেন তা প্রকাশের কোন শব্দ আছে কিনা জানি না। তবে নীরবে কেউ যদি এক মুহূর্ত ভাবেন, আর তিনি যদি সত্যি মানব সন্তান হন, তিনি নিজেকে স্থির রাখতে পারবেন বলে ভাবা যায় না। তবে সাধারণের জীবন আর বীরের জীবন এক নয়, শেখ হাসিনা যে বীর সে প্রমাণ তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দিয়েছিলেন, প্রথম ভাষণেই, শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে বলে। কিন্তু সে শক্তি এত বিশাল তা হয়ত সেদিন কেউ চিন্তা করতে পারেনি। বার বার এ কলামে লিখেছি, শেখ হাসিনা ম্যান ইন দি মেকিং, তাঁকে নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখন আসেনি যে, আসলে কোন্ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছবে তাঁর বীরত্ব। তবে এই সময় অবধি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারে তাঁর সংগ্রাম ও বিজয় ইতিহাসের জাহাজ অকল্পনীয় এক গতিতেই চলছে। আমরা বাতাসের ভেতর বসে আছি বলে বুঝতে পারি না কত বাতাস চার পাশে। যা সৌরজগতের মতো শেখ হাসিনা আমাদের দিচ্ছেন। এই আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারে একটি যুগান্তকারী বিজয় জাতিকে উপহার দিয়েছেন। আগস্টের তিন তারিখ বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশে অবৈধ কোন্ কোন্ রাষ্ট্রপতি পেনশন পাবে না। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন আর আরেক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করেন। সামরিক সরকারের বন্দুকের মাধ্যমে যোগ হওয়া এই দুই কালো সংশোধনী বাতিল হওয়ার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারের একটি ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসে জাতির সামনে। সে ধাপের অনেক কাজ শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে করেছেন। এবার আরও একটি কাজ করলেন আগস্টের ৩ তারিখে। বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার ভিত্তিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যে সব তথাকথিত রাষ্ট্রপতি অবৈধ বলে চিহ্নিত হয়ে গেছেন তাঁদের ভাতা বাতিল করার। বাংলাদেশে এখনও বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারীদের উত্তরাধিকারী দুর্বৃত্তরা সংগঠিত। তাদের সংগঠিত দুর্বৃত্ত না বলে এখনও এ দেশে রাজনৈতিক দল বলা হয়। তাই এই দুর্বৃত্ত নেতাদের যখন ভাতা বাতিল হয়েছে তখন এ দেশে সমালোচনা শুরু হবে। তারা বলবে এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। অন্যদিকে যেহেতু এ দেশে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন থাকায় তাদের তৈরি সুবিধাবাদী এলিট শ্রেণী জন্মে গেছে- তারা বলবে, এ কথা প্রচার করার চেষ্টা করবে। আর এক শ্রেণীর এলিট তাতে বাতাস দেবে। এ নিয়ে ভলিউম ভলিউম লেখা লিখে ফেলবে। টিভি পর্দা ফাটিয়ে ফেলবে। তবে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নতুন প্রজন্মকে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে অবশ্যই গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে, এই ভাতা বন্ধের ভেতর দিয়ে কত বড় বিজয়টা এলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাদের নাম বাদ যাওয়ার পথে একটি ধাপ এগিয়ে গেল এ দেশ। অর্থাৎ যাদের হাত দিয়ে, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস হয়ে পাকিস্তানী চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিক্ষেত্রে তাদের দেশ ভবিষ্যতে আরও বড় ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে নিজের ঘরের ময়লা পরিষ্কার করতে পারবে। বাস্তবে কোন দেশেই, বিশেষ করে মুক্তি সংগ্রাম বা বিপ্লবের ভেতর দিয়ে যে দেশ সৃষ্টি হয় ওই দেশের সাংবিধানিক পদগুলো খুবই পবিত্র। তাই সংবিধানের আকাক্সক্ষার বিপরীতের কেউ ওই দেশের সাংবিধানিক পদে থাকতে পারে না। আমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করব কোন দেশের সংবিধান শুধুমাত্র কয়েকজনের লেখা একটি আইন বা বিধিমালার বই নয়। বাস্তবে জনগণের যে আকাক্সক্ষার ভেতর দিয়ে একটি দেশ সৃষ্টি হয়, ওই আকাক্সক্ষার লিখিত বা অলিখিত রূপই হলো ওই দেশের সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধান বা যাকে আমরা ’৭২-এর সংবিধান বলি এ সংবিধান মূলত ১৯৭১ সালে একটি দেশ পাওয়ার লক্ষ্যে গোটা জাতি যে একটি আকাক্সক্ষায় মিলিত হয়েছিল ওই আকাক্সক্ষাই আমাদের সংবিধান। এর বাইরে যাওয়ার কোন পথ আমাদের নেই। ১৯৭১ সালে এই আকাক্সক্ষার বাইরে এ দেশে যে কিছু মানুষ ছিল তারা কেউই এই সংবিধানের আকাক্সক্ষার সঙ্গে অঙ্গীভূত নয়। তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী, তারা কেউ রাজাকার, কেউ পিস কমিটি বা শান্তি কমিটির মেম্বার। এদের কখনই এই সংবিধানের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করার কোন সুযোগ নেই। সেদিন এ দেশের মানুষের আকাক্সক্ষাটা কেমন ছিল তা আমরা নিশ্চয় সকলেই জানি। যার জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট- ১৯৭১ সালে ১২ বছরের কিশোর বা ৮০ বছরের বৃদ্ধকে পাকিস্তানী আর্মি ধরে নিয়ে বলেছে, এই শুয়ারকা বাচ্চা বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ- তখন ওই কিশোর বা বৃদ্ধ নির্ভয়ে বলেছে, জয় বাংলা। আর সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠেছে পাকিস্তানী হানাদারের রাইফেল। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে তারা। অর্থাৎ জয় বাংলার আকাক্সক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা মৃত্যুকে নিয়েছে সহজে। তাদের মৃত্যু দিয়ে রক্ত দিয়ে যে আকাক্সক্ষাকে বাঁচিয়ে রেখে গেছে তাই আজ এ দেশের সংবিধান। এই সংবিধানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারী কারোরই কোন প্রকার অঙ্গীভূত হওয়া বা কোন সাংবিধানিক পদে থাকার সুযোগ নেই। নৈতিক অধিকারও নেই। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর, পিস কমিটির মেম্বার তাদের কোনদিন নৈতিকতা থাকবে না। নৈতিকতা থাকলে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে কোনক্রমেই যেত না। এরা সব সময়ই নীতিবর্জিত, অমানুষ। দেশের মানুষও তা খুব ভালভাবে বোঝে। যে কারণে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারীদের মূল ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের দল যখন পিস কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে তখন দেশব্যাপী সেøাগান উঠেছিল, ‘রাষ্ট্রপতি রাজাকার, দেশবাসী হুঁশিয়ার।’ বাস্তবে পিস কমিটির মেম্বাররা সবই রাজাকার। পিস কমিটির স্রষ্টা কুখ্যাত গোলাম আযম। এ কারণেই ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা একটি ধাপ এগিয়ে দিলেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারে। ভাতা বন্ধ হলো ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিল হওয়ার মাধ্যমে অবৈধ রাষ্ট্রপতিদের। এ পথে আরও অনেক দূর যেতে হবে বাংলাদেশকে। বঙ্গভবনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের যে তালিকা আছে, একদিন ওই তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে এই অবৈধদের। আর শুধু এখানেই থামবে না মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার করার এ স্রোত। একদিন ঠিকই ওই তালিকা থেকে বাদ যাবে পিস কমিটির চেয়ারম্যান যিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তারও নাম। শুধু এখানেই থামবে কি বাংলাদেশ? ইতিহাসের ও সত্যের রথের চাকা বড় নির্মম। অসীম শক্তিশালী। বাংলাদেশ সেই জায়গায় পৌঁছাবে একদিন, যেদিন এ দেশের সংবিধানের আকাক্সক্ষার যারা বিরোধী ছিল- এই রাজাকার, আলবদর, পিস কমিটির মেম্বার এরা কেউ কোন সাংবিধানিক পদে থাকতে পারবে না। আর যারা ছিল, তাদের নামও যেমন করে এই ৩ আগস্ট অবৈধ রাষ্ট্রপতির ভাতা মুছে গেল অমনি করে মুছে যাবে। শহীদের রক্তে, মায়ের অশ্রু ও বোনের আব্রুতে কেনা বাংলাদেশের শরীরের কোন জায়গায় কোন কলঙ্ক থাকতে পারে না। এ কলঙ্ক মোচনের যুদ্ধে অনেক বাধা আসবে। তার পরেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারের এই যুদ্ধে সবারই লক্ষ্য কিন্তু এক। চলার পথের গতিও এক। সে লক্ষ্য ও গতির রূপ প্রকাশ করতে কেবল নজরুলের থেকে ধার নিয়ে বলা যায়, আমরা সেই দিন হব শান্ত যেদিন এ দেশ হবে রাজাকার, আলবদর, পিস কমিটির মেম্বার মুক্ত। [email protected]
×