ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নগরপিতার কাছে নাগরিকের চাওয়া সামান্যই

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

নগরপিতার কাছে নাগরিকের চাওয়া সামান্যই

বাংলাদেশে সবকিছুই কেমন তাড়াহুড়োর মধ্যে শুরু হয়ে তড়িঘড়ি শেষ হয়। সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কিংবা বাস্তবানুগ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায়শই সম্ভবপর হয় না। ফলে ভুল হওয়ার কিংবা পরবর্তীতে কুফল দেয়ার সম্ভাবনা যেমন থাকে তেমনই জনজীবনেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু এসব নিয়ে ভাববার সময় ও সুযোগ কারও আছে বলে প্রমাণ নেই। যেন প্রতিদিনকার জীবন আমরা যাপন করি এবং আগামীকাল নিয়ে ভাববার ফুরসত কারোরই নেই। এটা যেমন ব্যক্তি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনই বৃহত্তর ক্ষেত্র যেমন সরকারের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। না হলে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এতটা তাড়াহুড়া করা হলো কেন? হ্যাঁ, অনেক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থাকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু তাই বলে নাগরিকের জীবনকে ধর্তব্যে না এনে কেবলমাত্র নির্বাচন করার জন্যই নির্বাচন ব্যাপারটাকে আর যাই-ই হোক, সুশাসন বলা যায় না। তারপরও, জনগণ আশা করে থাকে, নির্বাচনকে ঘিরে সেই আশার পারদ সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে, কারণ এই একটিমাত্র দিনেই জনগণ নিজেকে সবচেয়ে ক্ষমতাবান মনে করার সুযোগ পায়। ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এই শহরদ্বয়ের জনগণকে আবার সেই ক্ষমতাবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ক্ষমতা প্রয়োগের আগে প্রার্থীদের কে কেমন, কার কি যোগ্যতা এবং কে কার থেকে কিভাবে আলাদা, সেটি যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে এবং সর্বোপরি প্রার্থীদের কাছে নাগরিকের চাওয়ার তালিকাটি নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানী কিংবা উল্লেখযোগ্য শহরের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারণা দেখার সুযোগ হয়েছে। মূলত বছরখানেক আগে থেকেই প্রার্থীরা তাদের পরিকল্পনা নিয়ে জনসম্মুখে প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। রাজনৈতিক দলগুলো আগে থেকেই তাদের প্রার্থী ঠিক করে রাখে এবং তাদের জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট শহরগুলোর জন্য আলাদা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে সে সবের বালাই নেই। ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’র মতো নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার কিছুদিন আগে মাত্র ঠিক হয় কে হচ্ছেন প্রার্থী। ফলে জনগণের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা থাকে প্রার্থীদের যাচাই-বাছাইয়ে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নির্বাচনকে অরাজনৈতিক নির্বাচন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা থাকে সর্বত্র রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। ফলে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয় সাধারণের মনে। সেই বিভ্রান্তি শেষ পর্যন্ত কাটে না, কারণ প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কখনোই স্পষ্ট করে বলার সুযোগ নেই যে, তিনি আসলে কার পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। প্রায়শই একটি তথাকথিত নাগরিক কমিটির দোহাই দেয়া হয়ে থাকে; কিন্তু সেই নাগরিক কমিটির নাগরিকদের রাজনৈতিক চরিত্র ও অবস্থান সম্পর্কে সকলেই কমবেশি জানেন। কিন্তু ‘ভাসুরের নামটি মুখে আনা মানা’, তাই আমরা প্রার্থীদের দলীয় অবস্থান জানলেও নির্বাচনটি ‘আসলে অরাজনৈতিক’। যা হোক, উত্তর-দক্ষিণ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থীদের পরিচয় এই মুহূর্তে আমরা সকলেই জানি। মোটা দাগে তারা সকলেই পরিচিত মুখ, কেউ কেউ আবার টেলিভিশনের কল্যাণে অতি-পরিচিতও বটে। কিন্তু কারোরই কর্মদক্ষতার পরিচয় আমাদের জানা নেই। চট্টগ্রামের বর্তমান মেয়রের ক্ষেত্রে তো আমরা দেখতে পাই মোটা দাগের ব্যর্থতার চিত্র। গোটা শহর পানির নিচে ডুবে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। যানজটের কথা না হয় নাইবা বলি। নাগরিক সুবিধা যেটুকুর দায়িত্বই মেয়রের হাতে তার কোন ক্ষেত্রেই সফলতার কোন চিহ্ন চট্টগ্রামের বর্তমান মেয়র দেখাতে পারেননি। অপরদিকে, তার বিপরীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়ত খানিকটা ভিন্ন হলেও হতে পারে, বর্তমান মেয়রের ব্যর্থতার কারণে নতুনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার পক্ষ থেকেও চট্টগ্রাম শহরকে ঘিরে কোন কার্যকর ও সম্ভাবনাময় পরিকল্পনার খবর এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। অথচ এই শহরের গুরুত্ব কেবল চট্টগ্রামের নাগরিকের জন্যই নয়, গোটা দেশের জন্যই অপরিসীম। দেশের প্রধানতম বন্দর হওয়ায় এই শহরের নগরপিতার ওপরে বর্তায় বাড়তি জাতীয় দায়িত্বও। কিন্তু সেই দায়িত্বের রাজনৈতিক অপব্যবহার ছাড়া কোন ভাল উদাহরণ আমরা দেখিনি চট্টগ্রামের মেয়রের কাছ থেকে। রাজধানীর দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে দেখতে পাই যে, বিএনপিদলীয় মেয়র দীর্ঘকাল ধরেই ঢাকার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর খানিকটা অগণতান্ত্রিকভাবেই ঢাকা শহরের দুই অংশের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ। ফলে ঢাকা শহরের নির্বাচনের দিকে নাগরিকের আকাক্সক্ষামুখর মন ও দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল বিগত কয়েক বছর ধরেই। সেই কাক্সিক্ষত নির্বাচনের তারিখ যখন ঘোষিত হলো তখন স্বাভাবিকভাবেই অতি দ্রুততায় বদলে গেল সকল বাস্তবতা। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাসী রাজনীতির কারণে গত কয়েক মাস ধরে যখন সারাদেশে মানুষ পেট্রোলবোমায় পুড়ে মারা যাচ্ছিল এবং অনেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে আশা করতে ভুলে গিয়েছিলেন ঠিক সেই সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হওয়া উৎসব মানুষকে অনেকখানি স্বস্তি দিয়েছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। এবং সকল ধ্বংসযজ্ঞ শেষে বিএনপিও এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, এটাও অনেক আশার কথা। সেই আশাবাদকে সামনে রেখে রাজধানীর নাগরিকরা এখন তাদের কাক্সিক্ষত মেয়রের কাছ থেকে চাইছেন কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি উত্তর ও দক্ষিণের ক্ষেত্রে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়, কারণ, ঢাকা আসলে একটি মাত্র ‘বিরাট শহর’, এর সমস্যাবলী উত্তর কিংবা দক্ষিণে আলাদা নয়, বরং দুই অংশেই অভিন্ন ও সম্মিলিত। ফলে এই দুই অংশে যে বা যিনিই নির্বাচিত হন না কেন, কাজটি তাদের একত্রেই করতে হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার নাগরিকদের চাওয়ার তালিকাটিও কিন্তু অভিন্নই হবে এবং একথাও খুবই সত্য যে, দুই শহরের নগরপিতার কাছেই নাগরিকের চাওয়া একেবারে সামান্যই, কারণ, না-পেয়ে অভ্যস্ত নাগরিকের কাছে সামান্যই অনেক। একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রথমেই মনে করি যে, এই দুই শহরের নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী। বেঁচে থাকলেই কেবল নাগরিক-সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রশ্ন আসবে, জীবনটাই যদি না থাকে তাহলে অন্যান্য সুবিধায় কী বা আসে যায়? সেদিকটি বিচারে নাগরিকের জীবন নিরাপদ করার কাজটি নগরপিতাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই করতে হবে। যদিও এই দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর; কিন্তু তারপরও নগরপিতা হিসেবে নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপর মানুষ অনেক বেশি ভরসা করতে চাইবে, এই ভরসার জায়গাটিকে দায়িত্ব নিয়েই সুনিশ্চিত করতে হবে নগরপিতা ও তার পারিষদদের। দ্বিতীয়ত নাগরিকরা যাতে নিরাপদে এবং সময়মতো তার কর্মস্থলে যেতে-আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করাই হবে নির্বাচিত প্রতিনিধির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এই মুহূর্তে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যানজটের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল, কারণ এই অভিজ্ঞতা প্রতিটি মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বিষিয়ে তুলেছে। কোন আলাদিনের চেরাগ দিয়ে হলেও যানজট নামের এই দৈত্যের কবল থেকে নাগরিককে মুক্ত করতে হবে, নাহলে যিনিই মেয়র নির্বাচিত হন না কেন, তার অন্য কোন কাজেরই প্রশংসা সম্ভবপর হবে না নাগরিকের পক্ষে। শহরের জীবনযাত্রা যদি কেবলমাত্র যানজটের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে তাহলে বাকিটুকু আসলে সৃষ্টিশীলতার অন্ধকারে ডুবে যায়। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মানুষের পক্ষে কোন ভাল চিন্তা সম্ভবপর নয়। এখনও পর্যন্ত কোন প্রার্থীর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব আসেনি এই দৈত্য বধের ব্যাপারে। সকলেই আলগা-প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন কেবল; কিন্তু পৃথিবীর অন্য অনেক শহরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করার লক্ষণীয় কোন উপায় কারও ঘোষণা থেকেই আমরা জানতে পারিনি। এ ক্ষেত্রেও হয়ত রাতারাতি কোন বিপ্লব ঘটানো সম্ভব নয়; কিন্তু তাই বলে নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনার খবরও নাগরিক পাবে না প্রার্থীদের কাছ থেকে, সেটি সত্যিই বেদনাদায়ক। তাই, ভোট প্রার্থনার আগেই প্রার্থীদের প্রয়োজনে খোলা বিতর্কের আসরে হলেও নিজস্ব পরিকল্পনার কথা জনগণকে জানাতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থাপনা কোন রকেট সাইন্স নয়, তাছাড়া সরকারও ঢাকা এবং চট্টগ্রামকে যানজটমুক্ত করতে অত্যন্ত আগ্রহী, বেশ বড় অঙ্কের বাজেট প্রণয়ন করে দুই শহরেই সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক ফ্লাইওভার বা বাইপাস নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা এবং বেশকিছু পরিকল্পনাধীন প্রকল্পের কথা আমরা জানি, তাই নির্বাচিত নগরপিতার পক্ষে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় ধরনের কোন সমস্যা দেখা দেয়ার কথা নয়। কিন্তু পরিকল্পনার খবরটি তো নাগরিককে জানতে হবে, তাই না? এর বাইরে নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দেশের দুই প্রধান নগরীকে যদি পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যকর করে তোলা যায় তাহলে চিহ্নিত সমস্যার অনেকখানিই সমাধান হয় বলে আমার বিশ্বাস। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরের বেশিরভাগটাই নির্ভর করে নাগরিকের ওপর। নাগরিক হিসেবে নগরকে মানবিক ও ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখলেই নাগরিক দায়িত্বের অনেকটা পালিত হয়, আর ভালবাসলে তার ক্ষতিসাধন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং, এই দুই নগরের নাগরিকদের দায় এই নগরদ্বয়কে নোংরা যতটা কম করা যায় তার। হ্যাঁ, বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার বিশাল কার্যভারটি নগর কমিটির ওপরই ন্যস্ত, ফলে নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বটি দু’পক্ষেরই সমান, অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং নাগরিকের সম্মিলিত। কিন্তু কোন প্রার্থীকেই আমরা বলতে শুনিনি যে, এই মিলিত দায়িত্ব পালনের উদাত্ত আহ্বান। হয়ত, নাগরিককে প্রার্থীরা কেবল ভোটদাতা হিসেবেই দেখছেন, নাগরিকের জন্য কিংবা নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার সংস্কৃতিতে তারা কেউই হয়ত অভ্যস্ত নন। কিন্তু তারপরও নাগরিককে আশাবাদী হতে হয়। অনেকেই হয়ত বলবেন যে, সিটি কর্পোরেশনের হাতে ক্ষমতা সামান্যই, নগর-জীবনকে সঙ্কটমুক্ত করার জন্য নির্বাচিত নগরপতিরা ক্ষমতাহীন এবং মূলত সরকারের মুখাপেক্ষী। কথাটি সর্বৈব সত্য; কিন্তু এই সত্যের মধ্যেও যে করণীয় অনেক কিছু আছে, যদি সদিচ্ছা থাকে, তাও আমরা সকলেই জানি। আমাদের এই জানা সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে চাই ভবিষ্যত নগরপিতা ও তার পারিষদদের কাছ থেকে। ১৩ এপ্রিল ২০১৫ [email protected]
×