ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন॥ মুনতাসীর মামুন

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

(১২ এপ্রিলের পর) জেনারেল মুকিম উল্লেখ করেছেন, এ অঞ্চলের মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান থেকে বাঙালী হয়ে গেল। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াও শুরু হয় ১৯৪৭ থেকে। পাকিস্তানী আদর্শ প্রবল ছিল। কিন্তু তরুণ, প্রগতিশীলদের মধ্যে বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভও জন্ম নিচ্ছিল। ঐ প্রশ্নই তাদের বিদ্ধ করেছিল যে, এই পাকিস্তান কি আমরা চেয়েছিলাম? স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের নায়ক তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে এ রূপান্তরের বিষয়টি দেখা যায়। বাঙালী জাতীয়তা বোধের বিকাশ হচ্ছিল সমান্তরালভাবে যদিও পাকিস্তানী আদর্শও প্রবল ছিল, এবং একেবারে উপড়ে ফেলাও তা সম্ভব হয়নি, বর্তমান অবস্থা তার প্রমাণ। কিন্তু পাকিস্তানী আদর্শের বিপরীতে বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিত্ব নিজের স্থান করে নিয়েছে এবং অন্তিমে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জয়লাভ করেছে। এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর একটি প্রবন্ধে। উদ্ধৃতি খানিকটা দীর্ঘ সত্ত্বেও সংক্ষেপে সামগ্রিক বিষয়টি বোঝার জন্য তা প্রয়োজনীয়। “বাঙালী জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ইতিহাসের ব্যবহার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা জরুরী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্ছেদ পর্যন্ত সময়কাল বিশ্লেষণ করলে ইতিহাসবোধের নির্মিত ও জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ইতিহাস ব্যবহারের একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, সাবেক পূর্ববাংলায় সর্বব্যাপ্ত কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ পর্যায়ে ধর্মজ জাতীয়তাবাদ ক্ষয় করেছে এবং পর্যায়ে পর্যায়ে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী করেছে। ধর্মজ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাঙালী কোলাবরেটর রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, বিভিন্ন পীর ঘরানার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি পর্যায়ে পর্যায়ে নিঃশেষ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রের হেজিমনি ও পাকিস্তান রাষ্ট্র উত্থিত ধর্মজ জাতীয়তাবাদ সার্বিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং প্রতিরোধকারী ও প্রতিযোগী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হেজিমনি এবং বাংলাদেশ আন্দোলন উত্থিত বাঙালী জাতীয়তাবাদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মজ জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িকতার বদলে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের বহুত্ববাদিতা কলোনিয়াল ইতিহাসের অবদমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে। এ হচ্ছে পাকিস্তান আমলের উপনিবেশের অধীন একটি জনসমষ্টির ইতিহাস পুনর্দখলের এক লড়াই এবং এই লড়াইয়ে জয়ী একটি জনসমষ্টির নিজস্ব ইতিহাস নির্মাণের লড়াই।” বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’, পাক্ষিক জনকণ্ঠ, ঈদসংখ্যা, ২০০৩] মুক্তিযুদ্ধে আমরা পৌঁছেছিলাম কয়েকটি আকাক্সক্ষা নিয়ে, যেগুলো পরে বিধৃত হয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানেÑ গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এগুলো তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত ছিল না। সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার ফসল সেই সিদ্ধান্ত। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু আজীবন এই মূলনীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি এতটাই বিশ্বাসী ছিলেন যে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, এশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া আর কোন রাষ্ট্রনায়ক এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এই বোধটিরই আধিপত্য বিস্তার করে থাকার কথা ছিল। এবং ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তা ছিল ও যদিও তা নস্যাৎ করার জন্য ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। ১৯৭২-৭৫ সালে আমাদের মনে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র নিয়ে মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। ১৯৭৫ সালে এ সবকিছুরই পরিবর্তন হলো। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত আদর্শই আধিপত্য বিস্তার করে থাকল। সামরিক শাসনামল ও খালেদা জিয়ার আমলে সুচিন্তিতভাবে এই আধিপত্য বিস্তারের কৌশল নেয়া হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়াবলিতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি এবং বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এ কারণে পাঠ্যবই থেকে স্বাধীনতার দলিলপত্র পর্যন্ত বদলে ফেলা হলো। বিভিন্ন কলেজে ইতিহাসের বদলে ইসলামী ইতিহাস চালু করা হলো। এদের সহযোগী শক্তি হিসেবে উদ্ভব হলো জঙ্গী, মৌলবাদী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলসমূহ। এর নিট ফল হলো, আমরা এমন কয়েকটি প্রজন্ম পেলাম যাদের দেশ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধÑ ইতিহাসের সেই ধারা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। মৌল-জঙ্গীবাদের বিপদ সম্পর্কে ধারণাহীন। সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে উৎসাহী। এমনটি চলতে থাকলে, বাংলাদেশ হওয়ার মূল কারণটিই বিমূর্তির অতলে হারিয়ে যাবে। আর দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকলে, দেশের প্রতি ভালবাসা জন্মালে কী হবে। শেকড়হীন জাতির মানবিক স্থিতি থাকে। স্বদেশেই সে উদ্বাস্তু। বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান জাতিকে দ্বি-খণ্ডিত করেছেন। একদল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, আরেকদল বিপক্ষের। ফলে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সুদূরপরাহত। যদি প্রজন্ম জানে কোন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী তাহলে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ কম। (চলবে)
×