ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

নববর্ষ উৎসব, প্রতিবাদের মেলবন্ধন

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

নববর্ষ উৎসব, প্রতিবাদের মেলবন্ধন

বাংলা নববর্ষ এখন বিশ্বের সাতাশ কোটি বাঙালীর প্রধানতম ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। নববর্ষ ছাড়া বাঙালীর অন্যসব সামাজিক উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ যুক্ত রয়েছে। বাঙালী মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুর দুর্গাপূজা কিংবা খ্রীস্টানদের বড়দিনের উৎসবে সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ গত কয়েক দশকে বাড়লেও ধর্মীয় মোহরের বাইরে পহেলা বৈশাখই একমাত্র উৎসব, যা আবহমান বাংলার মেলা, সঙ ও গাজনের সীমানা অতিক্রম করে নগরে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশের সকল ধর্ম, জাতিসত্তা এবং ভাষাভাষী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। দুই শ’ বছর আগে জমিদারি প্রথা প্রবর্তনের পর এ দেশের জমিদাররা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বাংলা নববর্ষকে সামাজিক উৎসবে রূপান্তরিত করেছিলেন। রাজধানী ঢাকায় ব্যবসায়ীদের হালখাতার গণ্ডি পেরিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনটি শেকড়সন্ধানী বাঙালীর মিলনমেলায় পরিণত হওয়ার সূচনা ঘটেছে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। ছায়ানটের উদ্যোগে ঢাকায় বাংলা নববর্ষ প্রথম কয়েক বছর উদযাপিত হয়েছে বলধা গার্ডেনে। জনসমাগম বৃদ্ধির কারণে ১৯৬৭ সাল থেকে মূল আয়োজন রমনার বটমূলে স্থানান্তরিত হয়েছে। ছায়ানটের শিল্পীরা বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনা পার্কের বটমূলে রবীন্দ্রনাথের বর্ষবন্দনার মাধ্যমে উৎসবের সূচনা করেন। এরপর যুক্ত হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, যেখানে অংশগ্রহণ করেন সর্বস্তরের মানুষ। রাজধানীর বাইরে বাংলাদেশে এমন কোন জনপদ নেই, যেখানে ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় না। পহেলা বৈশাখ এ দেশের আদিবাসীদের উৎসবের দিন। ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। বলা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, ভারতীয়, পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থী। এর আগে তারা বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে অভিহিত করে এর ইসলামীকরণের এক হাস্যকর অথচ ভয়ঙ্কর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পঞ্চাশের দশকে বাঙালী যেমন বাংলা ভাষার ইসলামীকরণের চক্রান্ত প্রতিহত করেছিল দুই বাংলার খ্যাতিমান লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের মহাসম্মেলন আয়োজন করে, ষাটের দশকের শুরুতে সাড়ম্বরে পালন করেছিল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালীর শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য ‘ছায়ানট’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’, ‘সন্দীপন’ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মলাভ করেছে। ছায়ানটই উদ্যোগ নিয়েছিল রাজধানী ঢাকায় সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের, যে সংগঠনের মধ্যমণি ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও সানজিদা খাতুন শিল্পী দম্পতি। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ছায়ানটের এই প্রতিবাদ এখন সহস্র সংগঠনের বহুমাত্রিক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা মূর্ত হয়েছে ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে এবং পরিণতি লাভ করেছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভেতর ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করেছে ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেরও ভিত নির্মাণ করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত করে পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয়েছিল ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল প্রমুখ বলেছিলেন ভারতবর্ষে মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি, হিন্দু ও মুসলমান এক দেশে এক জাতি পরিচয়ে থাকতে পারে না। জিন্নাহর এ অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছিল ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রথমে আপত্তি করলেও একপর্যায়ে দেশভাগ মেনে নিয়েছিল। ভারতবর্ষে হিন্দু আর মুসলিম দুটি আলাদা জাতি এটি প্রমাণ করার জন্য তখন বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, যার চূড়ান্ত রূপ ছিল পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাব ও বাংলার দ্বিখণ্ডিতকরণ। পাকিস্তানের জন্য পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাঙতে গিয়ে দশ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের দর্শনকে অসার ও অমানবিক প্রমাণ করেছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল ভারতের সরকার ও জনগণ, যার প্রধান কারণ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের অঙ্গীকার। স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন কীভাবে পাকিস্তানী শাসকরা এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসররা ধর্মের নামে শুধু শোষণ-পীড়ন নয়Ñ গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে। ধর্মের নামে সকল প্রকার শোষণ-পীড়ন-বৈষম্য ও নরহত্যা অবসানের জন্য ১৯৭২-এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্মের নামে যে কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছেÑ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানী আদর্শের ধারকরা কখনও ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেনি। ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই তারা ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীদের, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং একটি অনন্যসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এরপর থেকে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দ্বারা, যাদের শক্তির উৎস ছিল সামরিক বাহিনী, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকাও বটে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য তাঁর দল আওয়ামী লীগকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ একুশ বছর। এই একুশ বছর এবং পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের দশ বছরকে আমরা বলি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির ‘পাকিস্তানীকরণ’ বা ‘ইসলামীকরণের’ অন্ধকার যুগ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করেছে কিংবা উপেক্ষা করেছে বটে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কখনও এ দেশে পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের প্রত্যাবর্তন মেনে নেয়নি। এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ হচ্ছেÑ সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এবং ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মহিমা কীর্তন। একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, যার সমাপ্তি ঘটেছে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিকট পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শোচনীয় আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের উৎসব এখন শুধু নির্দিষ্ট দিনে নয়, গোটা মার্চ ও ডিসেম্বরজুড়ে উদযাপিত হয়, যা চরিত্রগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। পাকিস্তানী আমলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে শাসকরা এবং তাদের সহযোগীরা হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক দোসররা বাংলা নববর্ষ উদযাপনসহ বাঙালীর যাবতীয় সাংস্কৃতিক আচার ও অভিব্যক্তিকে হিন্দুয়ানি বলে যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই এর ওপর হামলা করেছে। ২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে হরকাতুল জিহাদের জঙ্গীরা বোমাহামলা করে বহু মানুষকে হতাহত করেছিল। পরের বছর যখন জামায়াত ক্ষমতায়Ñ রমনার বটমূলসহ বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠানে জনসমাগম দ্বিগুণ হয়েছে, উৎসব আর প্রতিবাদ একাকার হয়ে গেছে। রাজধানীতে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছে ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত-লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষে লাখো মানুষ। কণ্ঠে ধারণ করেছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালনের কালজয়ী গান, যেখানে মূর্ত হয়েছে বাঙালিত্ব ও মানবতার শাশ্বত চেতনা। ঢাকায় নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি মূল ধ্বনি থাকে যা নেয়া হয় কালজয়ী সাহিত্য থেকে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে জামায়াত-বিএনপির লাগাতার হরতাল-অবরোধের নামে হত্যা ও সন্ত্রাস চলাকালে মৌলবাদী ঘাতকদের হাতে অভিজিত রায় ও ওয়াশিকুর রহমানের মতো মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যার পটভূমিতে আবাহন করা হচ্ছে বাংলা ১৪২২ সাল। এবার নববর্ষের মূল প্রতিপাদ্য ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’Ñ নেয়া হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে। শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ পুনঃস্থাপন করলেও এখনও মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অনেক অন্ধকার জমে আছে সমাজ ও রাজনীতির পরতে পরতে। এই অন্ধকার দূর করতে হলে বর্ষবরণের সাম্য ও সৌভ্রাত্রের মর্মবাণী হৃদয়ের গভীরে ধারণ করতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতির সকল ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার চেতনা। ১৩ এপ্রিল ২০১৫
×