ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মুখরক্ষায় সমঝোতার চেষ্টা

হরতাল-অবরোধ থেকে পিছু হটতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১ এপ্রিল ২০১৫

হরতাল-অবরোধ থেকে পিছু হটতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ চলমান হরতাল-অবরোধের মতো নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী থেকে পিছু হটতে চায় বিএনপি। তবে এ কর্মসূচী থেকে সরে আসলে যাতে দলের দুর্বলতা প্রকাশ না পায় এজন্য তারা কৌশলে সরকারকে চাপে রেখে কিছু দাবি আদায় করে নিতে চায়। এর মধ্যে রয়েছে আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি, রাজনৈতিক মামলায় হয়রানি না করা, কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দেয়া, নিয়মিত সভা-সমাবেশ কর্মসূচী পালন করতে দেয়া, ৩ সিটির নির্বাচনী প্রচারকালে কাউকে গ্রেফতার না করা, এ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা ও খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। এ দাবিগুলো আদায়ের ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে সরকারী দলের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, নেতিবাচক টানা আন্দোলন কর্মসূচী থেকে সরে আসার ব্যাপারে ঘরে-বাইরে বিএনপি হাইকমান্ডের ওপর প্রবল চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলন থেকে সরে আসার পদক্ষেপ হিসেবে আসন্ন ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে আপাতত ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। ভেতরে ভেতরে সমঝোতার চেষ্টা করে কিছু দাবি আদায় করে সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বিঘেœ প্রচার চালানোর সুযোগ পেলে আস্তে আস্তে চলমান আন্দোলন কর্মসূচী তুলে নিয়ে রাজনীতির স্বাভাবিক ধারায় ফিরে যেতে চায় বিএনপি। আর সরকার দাবিগুলো মেনে না নিলে এবং সিটি কর্পোরেশনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের আশঙ্কা দেখা দিলে নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি সরাদেশে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত রাখবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ইতোমধ্যেই দলের কিছু সিনিয়র নেতা এবং বিএনপিপন্থী শত নাগরিক কমিটি ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের নেতৃবৃন্দের কাছে আন্দোলন ও ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে এ কৌশলের কথা জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরাতো আন্দোলন দীর্ঘায়িত করতে চাই না। সরকারই আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। সরকার আমাদের দাবিগুলো মেনে নিক তাহলে আমাদের আর আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন, ৩ সিটি কর্পোরেশনে আমাদের দলের নেতাকর্মীরা প্রার্থী হয়েছেন এখন আমরা দেখতে চাই সরকার নির্বিঘেœ তাদের প্রচার চালাতে দেয় কি-না। তারপর আমরা আমাদের কৌশলে সামনে এগিয়ে যাব। বিএনপি জোটের টানা ৮৫ দিনের নেতিবাচক আন্দোলনে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্নভাবে নাশকতা চালিয়ে প্রায় দেড়শ’ মানুষকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে শুধু শুধু পেট্রোলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে প্রায় ৭০ জন। পেট্রোলবোমায় হয়ে এখনও সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে অনেক মানুষ। এ কর্মসূচী চলাকালে সহস্রাধিক যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। ভাংচুর করেছে আরও কয়েক হাজার যানবাহন। এছাড়া সারাদেশের বেশ ক’টি ভূমি অফিস এমনকি স্কুল-কলেজ ও ডিসি অফিসে পর্যন্ত বোমা বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই কোন কৌশলে আন্দোলন চাঙ্গা করা যায় তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। আন্দোলন চলাকালে কার কি করনীয় তা তিনি আগেভাগেই বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলের নেতাদের জানিয়ে দেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচীর দিন গুলশানের বাসা থেকে বের হতে না পারার বিষয়টিকে মনে রেখে এবার ৫ জানুয়ারির ২ দিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাত থেকে বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন খালেদা জিয়া। পরদিন তার গুলশান কার্যালয়ের পাশে ব্যারিকেড দিয়ে র‌্যাব-পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ৫ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। ওইদিন বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সমাবেশ করার ইচ্ছে পোষণ করেন খালেদা জিয়া। এজন্য তিনি তার গাড়িতে উঠে বসলেও পুলিশ গেট খুলে দেয়নি। একপর্যায়ে তার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা চিৎকার চেচামেচি করে গেটে লাথি মেরে প্রতিবাদ জানাতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে মারে। পরে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে তাকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে না দেয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। এরপর টানা অবরোধের মধ্যেই ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ছুটির দিন বাধে প্রতিদিন হরতাল পালন করে আসছে বিএনপি জোট। প্রথম দফায় রবিবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা টানা ৭২ ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় দফায় বুধবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টা এভাবেই বিবৃতি দিয়ে প্রতি সপ্তাহে হরতালের ঘোষণা দেয়া হতো। তবে স্বাধীনতা দিবস ও ৩ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৫ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত হরতাল দেয়নি বিএনপি জোট। তবে চলমান টানা অবরোধের মধ্যে ৩০ মার্চ সকাল ৬টা থেকে আবার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালন করে তারা। এ যাত্রায় সিটি নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়। তবে মঙ্গলবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলুর নামে পাঠানো এক বিবৃতিতে আজ বুধবার সকাল ৬টার পর হরতালের পরিবর্তে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী ও বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আবার পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। এসএসসি পরীক্ষার মধ্যে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে গেলেও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হওয়ার পর ১০ মার্চ ১২ ঘণ্টার জন্য হরতাল শিথিল করা হয়েছিল। এদিকে গুলশান কার্যালয়ে ৮৮ দিন ধরে অবস্থান ও ৮৫ দিন ধরে চলা টানা অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে ১ মিনিটের জন্যও খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ের বাইরে যাননি। ১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে তার মাজারে এবাং ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও যাননি খালেদা জিয়া।
×