ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ঐন্দ্রজালিক গণতন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ঐন্দ্রজালিক গণতন্ত্র

সেলুকাস কি সত্যি আমাদের দেশকে বিচিত্র বলেছিলেন? কেন তিনি এ কথা বললেন? তাঁর আমলের বিচিত্র দেশটি এখন যে কী ধরনের, কী আকারের তিনি জানেন না। জানলে আর যাই হোক নিশ্চিতভাবে মূর্ছা যেতেন। গত এক দশকে আমাদের দেশ ও তার রাজনীতি নিয়ে যে পরিমাণ লেখালেখি ও কথা হয়েছে নিঃসন্দেহে তা বিশ্বরেকর্ড করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সব যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে গেছে। একদিকে মানুষের সামনে যাওয়ার সংগ্রাম, মুক্তবুদ্ধির রাজনীতি, গণজাগরণ, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বোধ, অন্যদিকে দায়দায়িত্বহীন সাম্প্রদায়িকতা আর প্রতিবেশী দেশের নাম ভাঙ্গিয়ে গদিতে যাওয়ার উগ্রতা। সে কবে থেকে আমরা এগুলো দেখে আসছি। দিন যায়, বছর যায় কিন্তু কোন পরিবর্তন ঘটে না। এরশাদ আমলে গণতন্ত্রের জন্য যে আশা ও জাগরণ তা যদি সত্যি মনের কথা হতো আজ বাংলাদেশ এ জায়গায় এসে দাঁড়াত না। সেদিনের অপশাসন ও একনায়কের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পেছনে মানুষের শুভবোধের পাশাপাশি যে স্বার্থ ও কায়েমী মনোভাব সেটাই গণতন্ত্রকে আস্তে আস্তে গ্রাস করেছে। বাংলাদেশ যেমন সব সম্ভবের এক আশ্চর্য সুন্দর দেশ, তেমনি অসম্ভবেরও এক জ্বলন্ত উদাহরণ। যেটা নিয়ে কথা বলি না কেন মানুষ কিছুতেই ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। মানুষের কী দোষ? দেশ ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। সে রাজনীতিই যদি তাকে বিপথগামী আর উগ্র করে রাখে সে তো এমন আচরণ করবেই। অনেক বছর ধরে আমি একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দেশ ও সমাজে বাস করছি। এখানে মতান্তর আছে। রাজনীতিতে কোন কোন পর্যায়ে নোংরামি আছে। ল্যাং মারা গদি পাওয়ার জন্য কৌশল অপকৌশল সবই আছে। নেই শুধু সকালের কথা বিকেলে অস্বীকার করা বা দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলে বিবাদ। যখনই কোন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বড় বিপর্যয় কিংবা জনশাসনের বেলায় হুমকির কিছু ঘটে, তখনই সবাই এক ছাদের তলায় এসে দাঁড়িয়ে যায়। বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য বা সমঝোতায় কোন রাজনীতি বিলম্ব করে না। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টৌ। দেশের রাজনীতি নিয়ে লেখার মানুষের অভাব নেই। আমরা দূর দেশ থেকে যে ভ-ামি আর নষ্টামি দেখছি সেটা নিয়েই কথা বলব। গণতন্ত্রের নামে যে দানবীয় উল্লাস আর গদিতে যাওয়ার চেষ্টা, সেটা আগেও দেখেছি আমরা। কিন্তু একটা পর্যায়ে তো তার অবসান হতে হবে। বিএনপির রাজনীতিতে যাঁরা গণতন্ত্রের কথা বলেন তাঁদের জানা উচিত জন্ম থেকেই দলটি এ ধারা বা গণতন্ত্রের বিরোধী। কারণ তার জন্ম সেনাশাসনে। তা ছাপিয়ে ওঠার জন্য যে প্রক্রিয়া বা লাগাতার প্রচেষ্টা সেটা কোনকালেও ধারণ করেনি তারা। আজ আমরা কী দেখছি? যে ভারতবিরোধিতা আর সাম্প্রদায়িকতা ছিল তাদের গদি পাওয়ার মূলধন, সেটাও তারা অন্যভাবে ক্যাশ করার চেষ্টা করছে। এ দলের নজরুল খান ভারতের সাহায্য চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। পড়ে খুব হাসি পেল। আমরা বহুকাল থেকে বলে আসছি বিএনপির ভারতবিরোধিতার পেছনে আসলে ভোট ছাড়া কিছু নেই। বরং তারাই সে দেশের আসল সেবা দাস। একবার বিএনপি আমলে দেশে গিয়ে মনে হয়েছিল ভারতের কোন রাজ্যে আছি। চারদিকে ভারত ভারত গন্ধ। বাজারে চালু টাকা আর রাস্তাঘাটের সাইনবোর্ড না দেখলে বোঝা মুশকিল কোথায় আছি। সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ কী বিএনপি না আওয়ামী লীগের অবদান? তারপরও এরা ভারতবিরোধিতার নামে ভোট টানে। এখন যখন দেখছে সব আশা অস্তমিত তখন ভারতের কাছে দেন-দরবার অমিত শাহের নামে ধূম্রজাল তৈরি করে বিএনপি আবারও প্রমাণ করছে তারা আসলেই কোন নীতি বা আদর্শের ধার ধারে না। কারণ এখন তো ভারতের ভূমিকা আরও আগ্রাসী। তার শক্তি বেড়েছে, বিজেপি গদিতে, সীমান্তে শান্তি মাঝে মাঝেই শিরোনাম, তবু এখন কেন ভারতের দোয়া বা সাহায্য প্রার্থনা। এই সে দিনও তারা শাপলার ঘটনা দেশের শান্তি বা ঐক্যে কঠোর হওয়ার পেছনে প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন দেখেছেন গণজাগরণের সময় সেটা জানিয়েছেনও, হঠাৎ এমন কী হলো যে ভারত বন্ধু হতে পারে? এটাই আমরা ভেবে দেখি না। আদর্শহীন রাজনীতির তলানিতে এসে আমাদের বুদ্ধিজীবী বা মিডিয়ার একাংশও এখন পচনশীল। এরা মিলে ভারত আমেরিকার পায়ে ধরে বিএনপিকে গদিতে বসাতে চায়। অথচ কথায় কথায় এরাই এদের বিরোধিতা করে দেশে অশান্তির আগুন লাগায়। এটার নাম গণতন্ত্র? সেলুকাস কেন স্বয়ং ঈশ্বরও বলতে পারবেন না একজন নেতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আন্দোলনে না গিয়ে পার্টি আফিসে কেন বসে আছেন? ঘুমাচ্ছেন খাচ্ছেন বিবৃতি দিচ্ছেন। কেউ জানে না হাসপাতাল থেকে কী করে আরেকজন হাওয়া হয়ে যায়। এ সব প্রশ্নের উত্তর ছাড়া কি গণতন্ত্র গাছ থেকে ঝরে পড়বে? গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ সবার আগে জানে, জেনে বুঝতে চায় তারপর মাঠে নামে। কেউ গাড়িতে আগুন দেয় না। রেললাইন উপড়ে ফেলে না, সকালে এক কথা বিকেলে আরেক কথা বলে না। সরকারও সব বিষয়ে উলিশ নদিয়ে মোকাবেলা করে না। সহ্য ধৈর্য মানা না মানা এগুলো পরিবার সমাজ ও দেশের ব্যাপার। সব জায়গায় না মানলে রাজনীতিও মানবে না। খালেদা জিয়ারা যা করছেন তা বন্ধ করতে হলে মানুষকে গণতন্ত্রের পাশাপাশি উদারতা শেখাতে হবে, না হলে আজ যারা বিরোধিতা কাল তার পায়ে ধরার রাজনীতিতে প্রভু পরিবর্তন হলেও জনগণের কোন মঙ্গল হবে না। বাংলাদেশ শান্তি চায়- এটাই বোঝেন না তারা। বিএনপি যে গণতন্ত্র চায় সেটা কি ম্যাজিক? মানুষজন ছাড়া কয়েকটা বোমা বা গ্রেনেডের ওপর নির্ভরশীল? কই একদিনের জন্যও তো লাখো মানুষের মিছিল সমাবেশ দেখলাম না। কেবল লুকিয়ে থাকা আর গরিব মানুষের ধর্ম বিশ্বাস পুঁজি করে রাজনীতি? সরকারী দলও দেখি তেমন। কোন যোগ্য উত্তর যুক্তি নাই। সব মিলিয়ে গণতন্ত্র যেন এক ম্যাজিক লণ্ঠন। যার যেমন ইচ্ছে তেমন করে ফুঁ দিচ্ছে। ভয় হয় পাশে না আগুন ধরে যায়। আমরা সেটা চাই না। দেশ ও জণগনের শান্তি না থাকলে কোন তন্ত্রই কিছু না। এটা আসল কথা। [email protected]
×