ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

একাকিত্ব ও স্ট্রেস: নগরজীবনের নীরব ঘাতক

নয়ন আসাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গাজীপুর

প্রকাশিত: ১৮:১৭, ২৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৮:২১, ২৮ জুন ২০২৫

একাকিত্ব ও স্ট্রেস: নগরজীবনের নীরব ঘাতক

ছবি: জনকণ্ঠ

নগরজীবন আমাদের অধিকাংশ মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের প্রয়োজনে এটি আমাদের দিয়েছে কর্মব্যস্ততা, ভিন্নধারার জীবনযাপন এবং প্রযুক্তির ছোঁয়া। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো শহর আমাদের দিয়েছে অজস্র সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু এই চাকচিক্যের আড়ালে খুব নীরবে সংকটে পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্য। বিশেষ করে চাপ এবং একাকীত্ব নগরজীবনের এক তিক্ত বাস্তবতা, যা অনেক সময় অলক্ষ্যে থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে নেতিবাচকভাবে।

কিছু ক্ষেত্রে শহরের জীবন মানেই যেন এক নিরন্তর সংগ্রাম। কর্মক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, চাকরির অনিশ্চয়তা, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, যানজট, অফিস কিংবা পারিবারিক সংকটের চাপ, সবকিছু মিলেমিশে তৈরি হয় এক বিশাল মানসিক চাপের জঞ্জাল।

এই চাপ শুধু কর্মজীবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; পরিবারের সব সদস্যকেই প্রভাবিত করে প্রায় সমানভাবে। পরিবারের পুরুষ, শিশু বা গৃহিণী—প্রতিটি স্তরেই কমবেশি প্রভাবিত হন এই চাপে। কর্মক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণের তাগিদ, সহকর্মীদের সাথে প্রতিযোগিতা, অফিসের অপরাজনীতি এবং কাজের দীর্ঘ সময় মানসিক চাপ শুধু বাড়িয়েই দেয়।

এর ফলে অনিদ্রা, উদ্বেগ এবং একসময় বার্নআউটের মতো গুরুতর সমস্যা অজান্তেই মানুষকে জীবনের খারাপ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। শহুরে মধ্যবিত্তকে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য অনেক সময় অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, অতিরিক্ত চাপ নিতে হয়—যা মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

তার উপর আধুনিক নগরজীবনে মানুষের হাতে সময় কম। ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার এবং সামাজিকতার জন্য পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় মানুষ ক্রমশ মানসিক চাপের শিকার হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা এবং শহরের দূষিত পরিবেশও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

নগরজীবন আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক মনে হলেও, এর অভ্যন্তরে থাকে এক যান্ত্রিক জীবনের কাঠামো। এই জীবনে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। কাজের সূত্রে পরিবার থেকে দূরে থাকা বা ছোট পরিবারে বসবাস করার প্রবণতা মানুষকে একাকী করে তোলে।

প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষকে বাস্তব জীবনের সামাজিকতা থেকে দূরে সরিয়ে ভার্চুয়াল জগৎকে কাছে নিয়ে আসছে। আর এই ভার্চুয়াল জগৎ যত বড়ই হোক না কেন, তা কখনওই সত্যিকারের মানবিক সম্পর্কের বিকল্প নয়। এর ফলে একাকীত্ব দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ এবং উদ্বেগ ডেকে আনে। যখন মানুষ তার অনুভূতিগুলো অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে পারে না, তখন তা মনের মধ্যে তৈরি করে প্রবল চাপ।

তাহলে এ থেকে বের হওয়ার উপায় কী? চাপ এবং একাকীত্বের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। ব্যস্ততার মাঝেও নিজের জন্য সময় বের করা, শখের পেছনে সময় দেওয়া এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম কিছুটা হালকা করতে পারে মানসিক চাপ। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, বাস্তব জীবনে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নিয়মিত শরীরচর্চা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।

হাঁটাচলা, সবুজের সাথে সময় কাটানো, সকালে ঘুম থেকে ওঠা ইত্যাদিও মনকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। সেই সাথে পর্যাপ্ত এবং নিরবচ্ছিন্ন ঘুম মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে অপরিহার্য। ঘুমের অভাব মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে।

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, জাঙ্ক ফুড ও অতিরিক্ত ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা এবং নৈতিকতায় অটল থাকা মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।

নিজেকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা না করা, কাজ বা সম্পর্কে ‘না’ বলতে শেখাও মানসিক চাপ কমাতে কার্যকর।

আর যদি মানসিক চাপ বা একাকীত্ব তীব্র আকার ধারণ করে এবং দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, তবে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা করা উচিত নয়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং এটি নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

নগরজীবন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। মানসিক চাপ এবং একাকীত্ব এই নেতিবাচক দিকগুলোর অন্যতম। সচেতনতা, নিজের যত্ন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সহায়তার মাধ্যমে আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে নগরজীবনেও একটি সুস্থ ও সুখী জীবনযাপন করতে পারি।

শহীদ

×