ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

খালের মৃত্যু, লঞ্চঘাটের বিলুপ্তি : টঙ্গীবাড়ীর দুঃখগাঁথা

মোঃ নাজমুল ইসলাম পিন্টু, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, টঙ্গীবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৩:৪৯, ২৬ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৩:৫১, ২৬ জুন ২০২৫

খালের মৃত্যু, লঞ্চঘাটের বিলুপ্তি : টঙ্গীবাড়ীর দুঃখগাঁথা

একটা সময় ছিল, যখন মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আড়িয়ল বাজারের লঞ্চঘাটে দাঁড়ালে চোখের সামনে ভেসে উঠত সারি সারি নৌকার দৃশ্য। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা থাকত নৌকা, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ নামত আর উঠত, বাজার থেকে ভেসে আসত হাঁকডাক। সেদিনের সেই খাল ছিল টঙ্গীবাড়ীর প্রাণ। সে ছিল শুধু পানি বইবার একটা খাত নয়—ছিল চলমান জনজীবনের গোপন শিরা, যেখানে নৌকার সঙ্গে ভেসে আসত মানুষ, মাছ, খাবার, সংস্কৃতি আর অর্থনীতি। আজ সেই খাল নেই। আছে শুধু স্মৃতি, ক্ষত, আর একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতার দীর্ঘ চিহ্ন।

সরেজমিনে গেলে বোঝা যায়, আড়িয়ল খাল যেন চোখের সামনে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে মারা গেছে। খালের বুক জুড়ে জমে আছে বাজারের উচ্ছিষ্ট, হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য, বাসাবাড়ির আবর্জনা। তার গায়ে গজিয়ে উঠেছে আগাছা, পচা পানি থেকে বেরোচ্ছে গন্ধ, মশা-কীট, রোগজীবাণু। খালপাড়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়, কোনো এক জীবন্ত নদীশিশুকে দিনের পর দিন শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, আর আমরা সবাই চুপ করে সেই দৃশ্য দেখেছি—কেউ কিছু করিনি।

এই খালটির ছিল এক বিশাল নেটওয়ার্ক। পদ্মা নদী ও ইছামতি নদী থেকে উঠে আসা ডহরী-তালতলা (গৌরগঞ্জ) খাল হয়ে বাতাসি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি শাখা বালিগাঁও লঞ্চঘাট ঘেঁষে পেট্রোল পাম্পের পশ্চিমদিক পেরিয়ে চলে গেছে আপরকাটি, নাগেরপাড় হয়ে আড়িয়ল বাজারের কোল ঘেঁষে। এরপর ডুলিহাটা, পলাশপুর অতিক্রম করে এই ধারা মিশেছে মোকামখোলা খালে। আরেকটি শাখা ডহরী গ্রামের উত্তর পাশ থেকে শুরু হয়ে মারৈল ও নওপাড়া পেরিয়ে বিলের বুক ছুঁয়ে এসে সংযুক্ত হয়েছে মূল আড়িয়ল খালে। এই পথ দিয়েই নামত বিলের পানি, আসত মাছ, তৈরি হতো খেতের প্রাণশক্তি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পদ্মা নদী থেকে উঠে আসা খালের একটি ধারা—যা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মিজানুর রহমান সিনহার গ্রামের বাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবেশ করে ভরাকর, কলমা, বাশিরা, বসাউল্লা হয়ে এসে মিশেছে আড়িয়ল খালে।
আজ সেই শিরাগুলো নেই। নেই সেই জোয়ার-ভাটা, নেই মাছের ছুটোছুটি, নেই নৌকার কোলাহল। শোক আছে, স্মৃতি আছে, আর আছে নীরব ধ্বংস। পদ্মা নিজেই যেন আজ বিস্ময়ে প্রশ্ন তোলে—“যেখানে আমার শাখা শুকিয়ে মরে গেছে, সেখানে মানুষের ভাগ্য কিভাবে বেঁচে থাকে?”
এই মৃত্যু কেবল প্রকৃতির নয়—এটা সময় ধরে চলা মানুষ্যসৃষ্ট আত্মহত্যা। দখল, ময়লা, নির্মাণ, অবহেলা—সব মিলে ধ্বংস করেছে এই খালটিকে। স্থানীয় মানুষ জানে, দিনের পর দিন খাল ভরাট করে দোকান উঠেছে, ঘর উঠেছে, নির্মাণ হয়েছে পাকা রাস্তা। কেউ ঠেকায়নি। বরং চোখের সামনে এসব দেখেও প্রশাসন থেকেছে চুপ।

স্থানীয় সংবাদকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ও সংগঠক অনিক শেখ বলেন, “আমি ছোটবেলায় দেখেছি খালে চলত নৌকা। নৌকায় করে ফেরিওয়ালারা আসত—মাটির হাড়িপাতিল, মুখরোচক খাবার, বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে। দেশি মাছ ধরা যেত, খালে নামলেই কাঁকড়া, টেংরা, পুঁটি পাওয়া যেত। এখন সেই খালে শুধু দুর্গন্ধ আর পচা পানি। পাড়ে দাঁড়ালে কষ্ট হয়, বুক ফেটে যায়। খালটা চোখের সামনে মারা গেছে—আমরা কিছুই করতে পারিনি।”

এই বক্তব্য শুধু অনিকের নয়—এটা হাজারো মানুষের হৃদয়ের ব্যথা। কৃষক বলছে, খালের পানি না থাকায় জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না, উৎপাদন কমে গেছে, খরচ বেড়েছে। অনেকে ঋণ করে কৃষিকাজ চালাচ্ছে, কেউ আবার চাষাবাদ ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছে। অথচ এটি একটি সরকারি খাল, সংরক্ষিত সম্পদ। সেই খাল দেখভালের দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু তারা কি সেই দায়িত্ব নিয়েছে? এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অসন্তোষ দানা বেঁধেছে।

আড়িয়ল বাজার বণিক সমিতির সেক্রেটারী নান্টু মাদবর বলেন, “এই খাল এক সময় আমাদের ব্যবসার মূল সাপোর্ট ছিল। লঞ্চঘাটে জাহাজ ভিড়ত, খাল দিয়ে মালামাল আনতে সহজ ছিল। এখন খাল বলতে শুধু ময়লা আর দুর্গন্ধ। খালপাড়ে দোকান আছে, কিন্তু পরিবেশ এমন যে ক্রেতা ঢুকতেই চায় না। অনেক বার আমরা বাজার পরিষ্কারের দাবি জানিয়েছি, কিন্তু সাড়া পাইনি। খালটা যদি পুনঃখনন হয়, শুধু ব্যবসা না—সার্বিক জীবনযাত্রাই উন্নত হবে।”

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে স্থানীয়দের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বেরিয়ে আসে। দখলদারদের নাম সবার মুখে মুখে ঘুরছে। তারা প্রকাশ্যে মাটি ভরাট করে খালকে গিলে খাচ্ছে, অথচ কেউ বাধা দিচ্ছে না। এর পেছনে কি প্রশাসনের কোনো নিরব সমর্থন আছে? নাকি এটাই সিস্টেমের ব্যর্থতা?
এমন বাস্তবতায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তাদের নিশ্চুপতা, ধীর পরিকল্পনা, দেরি করে পদক্ষেপ নেওয়ার সংস্কৃতি এই মৃত্যুর অন্যতম কারণ। দিনের আলোতে খাল গায়েব হয়ে যাচ্ছে, পাকা দালান উঠছে, অথচ তারা ‘তালিকা তৈরি হচ্ছে’, ‘পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন’ — এসব আশ্বাস দিয়েই পার করে দিচ্ছে বছরের পর বছর।

স্থানীয় বাসিন্দা সরোজ বলেন, “গারুর গাঁ, পাঁচগাঁও, চিত্রকরা, হাসাইল, রাজাবাড়ি ও দিঘীরপাড়—এইসব এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া বহু খালের মুখ এখন বন্ধ হয়ে আছে। পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হলে আড়িয়ল, বালিগাঁও, কলমা, ডুলিহাটা ও টঙ্গীবাড়ী এলাকায় অন্তত তিনটি পয়েন্ট খুলে দেওয়া জরুরি। এই প্রবাহ মোকামখোলা থেকে শুরু হয়ে টঙ্গীবাড়ী বাজার পেরিয়ে মিরকাদিম হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে মিশেছে।”

এই বিষয়ে জানতে চাইলে টঙ্গীবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আড়িয়ল খাল পুনঃখননের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
তবে স্থানীয়রা প্রশ্ন তোলে—তালিকা তো আগেও হয়েছে, কত বছর ধরে শুনছি এই আশ্বাস। দখল তো প্রকাশ্যে হচ্ছে, কাদের দখলে কোন অংশ, সেটা তো সবাই জানে। তাহলে এখনো উচ্ছেদ হয় না কেন? কেন চুপচাপ বসে থাকে প্রশাসন?

এই খালের মৃত্যু মানে শুধু পানি শুকিয়ে যাওয়া নয়—এটি একটি অঞ্চলের আত্মপরিচয়ের অপমৃত্যু। একদিন হয়তো আমাদের সন্তানেরা শুধুই বইয়ে পড়বে—“একটি খাল ছিল এখানে।” তারা জানতে চাইবে, “বাবা, খাল কী জিনিস? কেন তা নেই?” তখন আমরা হয়তো মুখ লুকাবো, কারণ আমরা জানব—আমরাই পারিনি আমাদের ইতিহাস বাঁচাতে।

এই মৃত্যু কেবল একটি খালের নয়—এটা ইতিহাসের মৃত্যু, এটা মানুষের অপারগতার মৃত্যু, এটা রাষ্ট্রের কর্তব্যচ্যুতির প্রতিচ্ছবি।

আর তাই এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার— কে মারল এই খালকে? কেন প্রশাসন এতদিন চুপ করে ছিল? এই দায় কি দখলদারদের একার, না কি প্রশাসনও তাদের একাংশ?

এই খাল আজ আমাদের চোখের সামনে মরেছে। এখনও যদি আমরা না জাগি, আগামীকাল মরবে আমাদের আরেকটি খাল, আরেকটি জনপদ। তাই সময় এখনই—জেগে উঠতে হবে, কথা বলতে হবে, দাবি জানাতে হবে—খাল চাই, ইতিহাস চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রকৃতি চাই।
জলধারার মৃত্যু মানে জীবনের মৃত্যু। দখলদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। প্রশাসনের নিরবতা ভাঙো। এখনই সময়—নইলে আর কিছুই থাকবে না।

Jahan

×