ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

রক্ষণাবেক্ষণের অপেক্ষায় দুই শত বছরের ঐতিহাসিক ছোট মসজিদ

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৮:৪০, ২০ জুন ২০২৫

রক্ষণাবেক্ষণের অপেক্ষায় দুই শত বছরের ঐতিহাসিক ছোট মসজিদ

ইতিহাসের পাতা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির গভীর থেকে উঠে আসা এক নিঃশব্দ সাক্ষ্য—মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ তাজপুর গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। প্রায় দুই শত বছর আগের নির্মিত এই ছোট্ট মসজিদটি যত না তার পরিমাপে বড়, তার চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত তার ধর্মীয় গুরুত্ব, ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য। দৈর্ঘ্যে মাত্র ২০ ফুট ও প্রস্থে ১৬ ফুট হলেও এই নিভৃত মসজিদটি যুগের পর যুগ গ্রামের মানুষের ঈমানি চেতনাকে শাণিত করে আসছিলো ততকালীন সময়ে, হয়ে উস্থানীয় মুসলিম হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গাঁথা এক নিরব মিম্বার।

বহুপুরোনো ইট ও চুন-সুরকির ছিমছাম নির্মাণশৈলীতে গড়া এই মসজিদে প্রতিটি খিলান, প্রতিটি দেয়ালে যেন সময়ের ছাপ লেগে আছে। এর কড়িকাঠ ও সাদাসিধে কারুকাজে ইসলামি স্থাপত্যের অনাড়ম্বর সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে নিপুণভাবে। আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া না লাগলেও, এখানকার শান্ত পরিবেশ ও ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ রীতি হৃদয়ে এনে দেয় অতীতের সোনালি দিনের ঘ্রাণ।

এটি শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং এ গ্রামের একটি আত্মিক কেন্দ্র। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নামাজ, কুরআন শিক্ষা ও ধর্মীয় পরামর্শের স্থান হিসেবে এই মসজিদটি পালন করেছিলো মৌলিক ভূমিকা। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, ততকালীন সময়ে এই ছোট মসজিদে বৃষ্টির দিনে আওয়াজে যখন কোরআনের তিলাওয়াত মিশে যেত, তখন এই মসজিদের ভেতরে এক স্বর্গীয় আবহ তৈরি হতো।

তবুও আজ এই মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে অবহেলায়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারাচ্ছে তার জৌলুশ। অথচ এর প্রতিটি ইট এখানকার  অতীতের নিঃশব্দ আরাধনার কণ্ঠস্বর। প্রয়োজন শুধু একটু যত্ন, একটু ভালোবাসা, আর প্রজ্ঞাপূর্ণ উদ্যোগ—তাহলেই হয়তো এই নিঃশব্দ সৌধ আবারও হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ তাজপুরের গর্ব, মুন্সীগঞ্জের ইসলামী ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক।

স্থানীয় প্রবীণদের মতে, ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন হিন্দু জমিদার শান্তি বাবুর পূর্বপুরুষরা তাঁদের মুসলিম খাজনা আদায়কারীদের জন্য মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এমন উদ্যোগ তৎকালীন সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত হয়। একদিকে জমিদারী কর্তৃত্ব, অপরদিকে ইসলামের প্রচার—এই মসজিদ যেন দুই সংস্কৃতির সংযোগস্থল হয়ে দাঁড়ায়।

মসজিদটি ছিল এলাকার ধর্মচর্চার এক সময়কার প্রাণকেন্দ্র। স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি লেবু মুন্সি বছরের পর বছর ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন এই মসজিদে। তবে তাঁর মৃত্যুর পর মসজিদটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এটি ব্যবহারের বাইরে। বর্তমানে এটি গাছপালা, ঝোপঝাড় ও বিশাল বটগাছের ছায়ায় আড়ালে থেকে যাচ্ছে জনচক্ষুর অন্তরালে। সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ধর্মীয় স্থাপত্য যেন স্মরণ করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের কথা।

সম্প্রতি গ্রামে একটি নতুন রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে মসজিদটির অস্তিত্ব আবারো সামনে আসে। তখন থেকেই এর সংরক্ষণ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। 

স্থানীয়রা বলেন সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা পেলে এই ছোট্ট মসজিদটি শুধু উপাসনালয় নয়, বরং ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠবে।

স্থানীয়রা জানান, মুরব্বিদের মুখে শুনেছি এটি জেলার সবচেয়ে ছোট এবং অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। ইতোমধ্যে এর পাশে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট করা হয়েছে এবং পুরোনো মসজিদ সংরক্ষণের পরিকল্পনাও চলছে। 

এ বিষয়ে সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিনা আক্তার বলেন, বিষয়টি আমাদের অবগত হয়েছি। যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দুই শত বছরের পুরোনো এই ছোট মসজিদটি নিছক একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়। এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, সহনশীলতা এবং ইসলামের স্থানীয় চর্চার এক মূর্ত নিদর্শন। ইসলামী ঐতিহ্যের সংরক্ষণ আজ কেবল অতীত স্মরণ নয়—বরং ভবিষ্যতের জন্য মূল্যবান উত্তরাধিকার সংরক্ষণ।

স্থানীয়রা বলেন এখন প্রয়োজন—ঐক্যবদ্ধভাবে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যাতে দক্ষিণ তাজপুরের এই নিঃশব্দ মসজিদ আবারও হয়ে উঠতে পারে ইসলামী সাংস্কৃতিক চর্চার জীবন্ত কেন্দ্র।

Jahan

×