
ছবি:সংগৃহীত
আর্থিক সমস্যা বা শারীরিক ত্রুটির কারণে বিয়ে না হওয়ার কথা অনেকেই শুনেছেন, কিন্তু কখনও কী শুনেছেন একটি পাকা রাস্তার অভাবে ৭ গ্রামের ছেলে-মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে? শুধু বিয়েই নয়, অ্যাম্বুলেন্স না পৌঁছাতে পারায় গর্ভবতী নারীরাও পড়ছেন চরম বিড়ম্বনায়। শিক্ষার্থী, রোগীসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রতিদিন চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের। সামান্য বৃষ্টিতেই পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ।
এমনই একটি গ্রামের চিত্র দেখা গেছে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী ইউনিয়নের বেংনাই গ্রামে। চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি এখন শুধু কাদা ও গর্তে পরিপূর্ণ।
পাঙ্গাসী ইউনিয়নের বৈকুণ্ঠপুর ভাঙাব্রিজ থেকে শুরু করে মিত্রতেঘরি নতুন বাজার পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই কাঁচা রাস্তা। রাস্তাটি বর্তমানে পুরোপুরি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই সড়ক ব্যবহার করে বেংনাই, মিত্রতেঘরি, নলছিয়া, বাসুরিয়া, জয়ানপুর, মাটিকোরা ও গঙ্গারামপুরসহ আশপাশের ৭টি গ্রামের প্রায় ৭ হাজার মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে।
এই রাস্তায় প্রতিদিন চলাচল করে বেংনাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী। এছাড়াও বেংনাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিত্রতেঘরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাটিকোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আরও প্রায় ৬০০ ক্ষুদে শিক্ষার্থীও একই দুর্ভোগের শিকার।
বেংনাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকার এই রাস্তার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়নি। প্রতিদিন অনেক শিক্ষার্থী কাদায় পড়ে গিয়ে আহত হচ্ছে। স্কুল ড্রেস নষ্ট হওয়ায় অনেকেই উপস্থিত হতে পারে না। অন্তত শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত রাস্তাটি পাকাকরণ প্রয়োজন।”
বেহাল রাস্তার কারণে অন্য এলাকার মানুষজন এই অঞ্চলের সঙ্গে আত্মীয়তা করতেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বর্ষার মৌসুমে অবস্থা আরও করুণ হয়ে ওঠে।
বেংনাই গ্রামের বাসিন্দা ও সুনামগঞ্জ গিলাছড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, “আমার একটি বোন আছে, বিয়ের উপযুক্ত। ইতোমধ্যে তিনবার ছেলের পরিবার দেখে গেছে। সর্বশেষ ঈদুল আযহার পর আরেকবার দেখতে আসে, কিন্তু রাস্তা না থাকায় সেই বিয়েটিও ভেঙে যায়।”
মিত্রতেঘরি বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, “অ্যাম্বুলেন্স আসতে না পারায় গর্ভবতী নারীরা বিপাকে পড়ছেন। জরুরি রোগীদের ভ্যানে নিতে গেলে অনেকেই রাস্তায় মারা যাচ্ছেন।”
ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, “দুই বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছি। কিছুদিন পরপর ভ্যান নষ্ট হয়ে যায়। রাস্তায় ভাঙা-চোরা থাকায় অনেকেই ভ্যানে উঠতে চায় না।”
বেংনাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, “একটি পাকা রাস্তার অভাবে পুরো এলাকার উন্নয়ন থমকে আছে। অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিকের পর ঝরে পড়ছে।”
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী লাদেন বলেন, “রাস্তা না থাকায় বৃষ্টির দিনে আমরা স্কুলে যেতে পারি না। সরকারি স্কুলের রাস্তাও যদি কাঁচা থাকে, তাহলে আর দুঃখের কী হতে পারে?” বৃষ্টিতে চলাচলের সময় ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্ম কাদা-মাটিতে নষ্ট হয়ে যায়।
বেংনাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমার স্কুলসহ মিত্রতেঘরি ও মাটিকোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই কাদা ও পানিতে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এতে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের।”
এলাকার পক্ষে লিটন হোসেন জানান, “এখানে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাট-বাজার, মসজিদ-মাদ্রাসা রয়েছে। বহুবার জনপ্রতিনিধিদের জানানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখে আমরা এখন উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার।”
পথচারী আকুল হোসেন বলেন, “আমি এই এলাকার জামাই। বৃষ্টির দিনে শ্বশুরবাড়িতে এলে জুতা হাতে আর প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত তুলে আসতে হয়। বিয়ের পর থেকেই এই রাস্তার এই অবস্থা দেখে আসছি। রাস্তা না থাকায় এই গ্রামের মেয়েদের ভালো সম্বন্ধ আসে না, আর বিয়েও হচ্ছে না।”
এ বিষয়ে রায়গঞ্জ উপজেলার প্রকৌশলী রবিউল আলম জানান, “আমরা এলাকাবাসীর কাছ থেকে ইতোমধ্যে তথ্য পেয়েছি। পরবর্তী ধাপে রাস্তাটি উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে।”
মারিয়া