
ছবি:জনকণ্ঠ
এক সময় গ্রামীণ জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ঘোড়া ও গরুর গাড়ি। প্রাচীনকাল থেকে যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতো এসব বাহন। মেঠো পথ ধরে ধীরে চলা এই বাহনগুলো ছিল কৃষক ও সাধারণ মানুষের নির্ভরতার প্রতীক। কালের বিবর্তনে এবং যান্ত্রিকতার দাপটে আজ এসব বাহন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছে।
মাত্র দুই দশক আগেও বিয়ের আয়োজন কিংবা উৎসব-পার্বণে ঘোড়ার গাড়ির কদর ছিল সর্বত্র। বর-কনেকে বহনে কিংবা পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ির বিকল্প ভাবা যেত না। যার ঘরে ঘোড়ার গাড়ি থাকত, তার সামাজিক মর্যাদাও ছিল আলাদা। গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল আরও বিস্তৃত। কৃষিকাজ, হাট-বাজারে যাতায়াত, অথবা পারিবারিক প্রয়োজনে গরুর গাড়ি চালাতেন গ্রামের মানুষ।
কাশিমাড়ী গ্রামের প্রবীণ ব্যবসায়ী সবুর মোল্লা জানান, ‘৪০ বছর আগেও আমাদের এলাকায় প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একটি করে গরুর গাড়ি ছিল। বিত্তবান পরিবারে তো একাধিক গাড়ি থাকত। সেসব গাড়ি ভাড়ায় চালিয়ে সংসার চালানো হতো।’
আজকের দিনে সেই দৃশ্য একেবারে বিলুপ্তপ্রায়। প্রযুক্তির উন্নয়ন আর নতুন বাহনের আগমনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে। বাস, মাইক্রোবাস, নছিমন, অটোভ্যান, পিকআপ—এইসব আধুনিক বাহনের প্রভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে গরু ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার।
শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া গ্রামের প্রবীণ ঘোড়ার গাড়ি চালক সাদেক আলী reminisces (স্মৃতিচারণ করে) বলেন, ‘আগে যখন শ্বশুরবাড়ি আসতাম, ঘোড়ার গাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে আসতাম। সেই গাড়িই ছিল একমাত্র বাহন। এখন সে দিন নেই, গাড়িও নেই।’
কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের শহিদ মিয়া জানান, ‘ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমি এখনো একটি ঘোড়ার গাড়ি রেখেছি। ঘোড়াসহ গাড়িটি ৭০ হাজার টাকায় কিনেছি। শহরে এখনো অনেকে মালামাল কম খরচে বহনে এটি ব্যবহার করতে পারেন।’
কাশিমাড়ী গ্রামের সাবেক গাড়িয়াল মাহতাব জানান, ‘৩০-৪০ বছর আগেও আমি ৫ জনের পরিবার চালাতাম ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় খাটিয়ে। এখন আর এই পেশা নেই, গাড়িও নেই।’
কাশিমাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বাবলু বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম ঘোড়ার গাড়ি দেখেইনি। এখন তাদের এসব ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করাতে হলে জাদুঘরে নিতে হবে।’
এক সময়কার জনপ্রিয় গাড়িয়ালদের গান—‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে...’—এখন কেবল পুরোনো গান হয়ে গেছে। না আছে সেই সুর, না আছে সেই বাহন।
বংশপরম্পরায় যারা গাড়িয়াল পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, তারাও আজ পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনেক উপাদান যেমন বদলে গেছে, তেমনি অনেক কিছুর অস্তিত্বও বিলীন হতে চলেছে। ঘোড়া ও গরুর গাড়ি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবেশবান্ধব এই বাহনগুলো শুধুই ঐতিহ্য নয়, আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ। এ ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে সরকার ও সমাজের যৌথ উদ্যোগ জরুরি। তা না হলে অচিরেই এই স্মৃতিচিহ্নগুলো পুরোপুরি হারিয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কেবল গল্প হয়েই থাকবে।
ছামিয়া