
টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে সিলেট নগরীর অধিকাংশ এলাকা। সোমবার দুপুরে শাহজালাল উপশহর থেকে তোলা
দুদিন বৃষ্টি না হওয়ায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হলেও রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ভারি বর্ষণে পরিস্থিতি পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে। সিলেটের উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। রবিবার শেষ রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ভারি বর্ষণে নগরীর জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অনেক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পানি প্রবেশ করেছে। কয়েকটি প্রধান সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ ঠেকাতে রাত জেগে পাহারা দেন নগরবাসী। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। এসব এলাকার বিদ্যুৎ, পানি ও খাবারের সংকট তৈরি হয়েছে। নতুন করে ছয় হাজার পরিবার ভোগান্তিতে পড়েছে।
সব মিলিয়ে এখন ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে গেছে। উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এখনো পানিবন্দি রয়েছেন লাখো মানুষ। রবিবার সকাল ৬টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ২২৬ দশমিক ছয় মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরপর সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত আরও ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সোমবার দুপুর ১২টায় সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, কুশিয়ারার অমলসিদ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের অসম ও ত্রিপুরা রাজ্যে গত ২৪ ঘণ্টার ২০০ মিমির বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনসহ ১৪ উপজেলায় বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ছয় লাখেরও বেশি। এসব উপজেলার ৫৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছে এক হাজার ৪শ’ মানুষের। সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ শাখা জানায়, নতুন করে আরও চারটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলররা খাবার পানি, স্যালাইন বিতরণ করছেন।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা জানান, সিলেটে ভারি বৃষ্টিপাত আগামী কয়েকদিন থাকতে পারে। এ ছাড়া মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সিলেটের দিকে চলে এসেছে, যার ফলে সামনের দিনগুলোতে বৃষ্টি আরও বাড়তে পারে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বড় বড় খাল ও নালা দিয়ে সুরমার পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। ফলে মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, ছড়ারপার, কুশিঘাট, চালিবন্দর, কামালগড়, যতরপুর, সুবহানীঘাট, দক্ষিণ সুরমা, বরইকান্দিসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদের সামনেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আকস্মিক জলাবদ্ধতার কারণে নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলা সোমবারের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, আগে থেকে নগরের নয়টি ওয়ার্ডের কিছু এলাকা প্লাবিত ছিল। রবিবার রাতের বৃষ্টিতে নগরীর অধিকাংশ এলাকাই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়েছে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নিচতলায়। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন কলেজের শিক্ষার্থী ও হাসপাতালের রোগীরা।
তবে চিকিৎসা ব্যবস্থা অব্যাহত আছে জানিয়ে এই হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, হাসপাতালের জেনারেটর রুমে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সেবা ব্যাহত হতে পারে। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া সোমবার সকালে সাংবাদিকদের জানান, ভোররাত থেকে হাসপাতালের প্রধান ফটকসহ আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।
এতে হাসপাতাল ভবনের নিচতলার প্রায় প্রতিটি কক্ষে পানিতে প্লাবিত হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন রোগী এবং চিকিৎসা দিতে আসা চিকিৎসক ও কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ওসমানী মেডিক্যালে কেন জলাবদ্ধতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের নিচতলা পুরোটাতেই পানি ঢুকেছে। গত বছর বন্যার সময় পানি ঢুকেছিল, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বারবার জানানো হলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় বৃষ্টি হলে এই অবস্থা হয়।
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র বলছে, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের উত্তর পাশঘেঁষে প্রবাহিত ছড়ার আশপাশে বিভিন্ন ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। এ কারণে ছড়া দিয়ে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক বাসিন্দা পানির প্রবাহ ওসমানী মেডিক্যালের একমাত্র ড্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। ফলে ড্রেন উপচে বৃষ্টির পানি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রে প্রবেশ করে।
চিকিৎসা নিতে আসা লোকজন জানান, প্যাথলজি বিভাগ, ২৬, ২৭ ও ৩১ নং ওয়ার্ডে হাঁটুসমান পানি রয়েছে। বিভিন্ন কক্ষে পানি প্রবেশ করার ফলে অনেক মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিচতলার মেঝেতে যারা চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তড়িঘড়ি করে তাদেরকে একজনের বিছানায় দুইজন রোগীকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ডে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি প্রবেশ করার ফলে চিকিৎসা নিতে এসে উল্টা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ায় কলেজের সোমবারের সব পরীক্ষা ও ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। সকালে ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে পানি ঢোকায় দুই শতাধিক রোগীকে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া বন্ধ হয়ে পড়ে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা কার্যক্রম। সকালে হাসপাতাল চত্বরের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও বা কোমরসমান পানি জমে যায়। কর্মকর্তাদের কক্ষেও পানি ঢুকে পড়ে।
তবে বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতল চত্বর থেকে পানি নেমে গেছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে সেবা কার্যক্রম। সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালের নিচতলা ও রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে ভোর থেকে পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে ঘুমন্ত রোগী ও স্বজনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফ্লোর, বারান্দা ও প্রবেশপথ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন রোগী ও তাদের স্বজনরা। তাই কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে তাদের অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তর করে।
এ ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রসহ প্যাথলজি বিভাগে পানি প্রবেশ করায় এর কার্যক্রম সকালে বন্ধ ছিল বলে জানিয়েছেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী। তিনি জানান, বানের পানি প্রবেশ করায় চিকিৎসাসেবা কিছু সময় ব্যাহত হয়। দুই শতাধিক রোগীকে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এ ছাড়া রক্ত সঞ্চালন বিভাগ এবং প্যাথলজি বিভাগে পানি প্রবেশ করায় এখনাকার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পানি নামার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসাসেবা দ্রুত স্বাভাবিক করে। কলেজে পানির কারণে তিনটি ক্লাস-পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী।
রবিবার বিকেলে সিলেট নগরীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়টি জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ। তার দেওয়া তথ্যমতে, রবিবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত সিলেট নগরীসংলগ্ন সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমা থেকে এক সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু রাতের এই অতি বৃষ্টিতে পানি বৃদ্ধি পায়।
রবিবার রাত ১২টার পর থেকে সিলেটে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। টানা ছয়-সাত ঘণ্টা বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যাপ্লাবিত উপজেলাগুলো ও নগরীর নিম্নাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে।