
দেশের মধ্য-দক্ষিণ বা ভাটিবঙ্গের ছোট্ট একটি জনপদ মাদারীপুর
দেশের মধ্য-দক্ষিণ বা ভাটিবঙ্গের ছোট্ট একটি জনপদ মাদারীপুর। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, ময়নাকাটা ও পালরদী নদীর পলি বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপ-লাবণ্যে পরিপূর্ণ এক উর্বরভূমি। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য আর ইতিহাস ঐতিহ্যের মাঝেই জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে একাধিক পিকনিক স্পট বা বনভোজনের স্থান। এ জেলায় আধুনিক রিসোর্ট অথবা বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা কোনো পিকনিক স্পট নেই।
প্রকৃতি ইতিহাস ঐতিহ্যের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে অনাবিল আনন্দ। জীবন উপভোগ করার মতো মনোরম পরিবেশে পিকনিক করে প্রফুল্ল মনে ঘরে ফিরতে পারবেন শৌখিন প্রকৃতিপ্রেমীরা। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের দৃশ্যপট দেখতে যেমন শিল্পীর চিত্রপটে আঁকা ছবির মতো, তেমনই এখানে রয়েছে প্রাচীন সব ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন। এ অঞ্চলের মানুষ কখনো প্রকৃতির মতো শান্ত; আবার কখনো ভয়ঙ্কর সিংহ-শার্দুল। বসুন্ধরা যেন আগে থেকে সবকিছু সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর অনাগত সন্তানদের জন্য।
ছোট্ট জনপদ হলেও এখানে জন্ম অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, মনীষী, কবি-সাহিত্যিক, আধ্যাত্বিক সাধক-মহাপুরুষ। যাঁদের মধ্যে ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ হাজী শরীয়তউল্লাহ, নীলকর বিদ্রোহী নেতা ও সমাজ সংস্কারক পীর মোহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া, অলৌকিক শুদ্ধপুরুষ গণেশ পাগল, জগদীশ পরমহংস দেব, ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ, পীর আমির আলী শাহ, ব্রজবাসী পতিতপবন গোস্বামীর মতো শুদ্ধপুরুষ।
বিশ্বখ্যাত স্থপতি ড. এফ. আর খান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বহু বিপ্লবীর জন্ম এই মাদারীপুরে। চির চঞ্চলা এই ক্ষুদ্র জনপদটির যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য। এই মাটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব এবং কিশোর বেলা থেকে শুরু করে জাতির পিতা হয়ে ওঠার আগে ও পরের অসংখ্য স্মৃতি। তাঁর সেই সব স্মৃতি আজও এ অঞ্চলের মানুষ তাদের হৃদয় খাঁচায় বন্দি করে লালন করছেন পরম মমতায়। বঙ্গবন্ধুর পদচারণায় নক্ষত্রের মতো আরও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
পদ্মা সেতু পার হলেই মাদারীপুরে প্রবেশ পথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দু’পাশে শিবচরের সর্বত্র চোখ ধাঁধানো ও মনকাড়া দৃশ্য দেখা যাবে। যার প্রতিটি দৃশ্য এবং স্থাপনা আপনাকে কাছে টানবে। শিবচরের কোণে কোণে রয়েছে পিকনিক করার মতো স্থান। উপজেলা শহরকে সাজানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা অলংকরণে। নানা স্থাপনার নাম রাখা হয়েছে ঠিক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময়ে।
শিবচরকে বলা হয় পদ্মাপাড়ের এক টুকরো সোনার বাংলা। এখানে পিকনিক করার মতো শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব হেল্থ টেকনোলজির উন্মুক্ত স্থান, রবীন্দ্র সরোবর, এক্সপ্রেসওয়ের পাশেই ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ট্রমা সেন্টারের খোলা স্থান, দাদা ভাই উপশহরের উন্মুক্ত প্রান্তর। আবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভাঙ্গা থেকে মাদারীপুরে প্রবেশ করার আগেই টেকেরহাট বন্দরে ডানে একটু সামনে গেলেই পাওয়া যাবে প্রকৃতির নিরিবিলি পরিবেশে নানা প্রজাতির পাখ-পাখালীর কলরবে আর মায়া মমতার আঁচল বিছানো বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট।
রাজৈর উপজেলা খালিয়া ইউনিয়নের ঠিক এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে গণউন্নয়ন প্রচেষ্টার শান্তি কেন্দ্র পিকনিক স্পট, প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন খালিয়া রাজারাম মন্দির। সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি নির্মিত।
এক সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক ও পিকনিক পার্টির আগমন ঘটত। শীতকালে বাগান সংলগ্ন পুকুরে আগমন ঘটত বিচিত্র সব পাখি। ফলে খুব সহজেই আকৃষ্ট হতো পর্যটকরা।
সদর উপজেলার উপমহাদেশের দ্বিতীয় ডান্ডি খ্যাত চরমুগরিয়া বন্দর এক সময় পিকনিক পার্টির পদচারণায় মুখর থাকত। তখন এখানে প্রায় ১০ হাজার বানরের বসবাস ছিল। তখন এখানে বড় বড় পাট ব্যবসায়ী বিশেষ করে মাড়োয়ারীরা ব্যবসা করতেন। তারা এই বানরগুলোর খাবার জোগান দিতেন। পিকনিক পার্টির লোকজন বানর দেখতে এখানে পিকনিক করতে আসতেন। পরবর্তীতে নানা প্রকৃতি ও ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করে বর্তমানে এই এলাকায় টিকে আছে প্রায় হাজার দুয়েক বানর।
মাড়োয়ারিরা এখান থেকে চলে যাওয়ায় বানরকুল চরম খাদ্য কষ্টে পড়ে এবং ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের বাড়ি বাড়ি হামলে পড়তে থাকে। আর পিকনিক করতে আসা মানুষের খাবার কেড়ে নিয়ে যেত। যে কারণে এখন আর কোনো পিকনিক পার্টি আসে না। আগের মতো এই অঞ্চলের ফলজ গাছ না থাকায় চরম খাদ্যাভাবে পড়েছে এ বানরগুলো। তবে চরমুগরিয়া বন্দরে কি পরিমাণ বানর রয়েছে তার সঠিক হিসাব নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও মাদারীপুর বন বিভাগ ও পশু সম্পদ বিভাগের মতে, চরমুগরিয়া বন্দরে বর্তমানে এক হাজারের মতো বানর আছে। একটা সময় এই বন্দরের কয়েক হাজার ছিল।
সে বানরগুলো চরমুগরিয়ায় ছয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে বসবাস করত। এই স্থানগুলো হলো চরমুগরিয়া এলাকার কালীবাড়ী, জে.টি.সি. থানা বা ফাঁড়ি, জেমস একাডেমি, নদীর পাড় ও জমাদ্দার মিল এলাকা।
চরমুগরিয়া বসবাসরত মানুষজনের মতে, বর্তমানে বানরের সংখ্যা প্রায় ১২শ’। বানরগুলো কালীবাড়ী, স্বর্ণকার পট্টিতে এক অংশ, চৌরাস্তা, নদীর পাড়ে এক অংশ এবং জেটিসি ও আদমজীতে আরেক অংশ থাকতো। এক অংশের বানর অপর অংশে প্রবেশ করে না। ভুলক্রমে যদি কোনো বানর অন্য অংশে ঢুকে পড়ে তবে যুদ্ধ বা ঝগড়া লেগে যেত। এই বানরগুলো আজ ক্ষুধার তাড়নায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে এমনকি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিসে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, খাবারের দোকানে হানা দিচ্ছে।
এক সময়ের পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হতো সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর নীলকুঠি। লোকে বলে ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি। এই নীলকুঠি ইংরেজ শাসন আমলে মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামে স্থাপন করা হয়। এর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও কৃষক নির্যাতনের অভিশপ্ত নীলকুঠির চুল্লীর একটি চিমনী কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ইংরেজ ডানলপ সাহেব ছিলেন একজন নীলকর এবং নীলকুঠির ম্যানেজার। ডানলপ সাহেবের বিশ্বস্ত গোমস্তা ছিল পাচ্চরের কালী প্রসাদ নামে এক ব্যক্তি। ইংরেজরা নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা নিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে এখানে এসে আউলিয়াপুর গ্রামের প্রায় ১২ একর জমির ওপর নীল কুঠি স্থাপন করেন ডানলপ। কৃষকদের আপত্তির পরেও তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে কৃষকদের বাধ্য করা হয় নীল চাষে।
এই আউলিয়াপুর গ্রামটি মাদারীপুর সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। ধ্বংস হয়ে যাওয়া নীলকুঠি অভিশপ্ত হলেও মানুষের কাছে এটাকে ঘিরে নানা কৌতূহল রয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ নীলকর সাহেবদের নির্যাতনের করুন ইতিহাস জানার আগ্রহটাও কম নয়। তাই ঐতিহ্য অভিশপ্ত হলেও প্রাচীন স্মৃতি তুলে ধরতে ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি হতে পারে পিকনিক স্পট ও জেলার সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। যা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক আগে মাঝে মধ্যে দু’একটি পিকনিক পার্টি আসতো। কিন্তু এখন তাদের দেখা পাওয়া যায় না। সরকারি উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় গড়ে উঠছে না পর্যটন কেন্দ্র।
শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ২০ একর এলাকাজুড়ে খনন করা শকুনি লেক। লেক কৃত্রিম হোক বা প্রাকৃতিক হোক যে কোনো সরোবর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। শকুনী লেকের চারপাশের সড়ক প্রাতঃভ্রমণকারী সব বয়সী মানুষের শারীরিক কসরতের প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সকালে দেখা যায় সমবয়সী কিশোর কিশোরীদের প্রাণচাঞ্চল্য। গাছের তলায় ছায়ায় বসে গা ভাসিয়ে খুঁজে বেড়ায় ছেলেবেলা।
চল্লিশের দশকে নগরায়ণের প্রয়োজনে এই লেকটি খনন করা হয়। বর্তমানে এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য মানুষের মন কেড়ে নেয়। বর্তমানে শকুনি লেকের সৌন্দর্য আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর